কাশীকান্ত মৈত্রঃ একটি নক্ষত্র বিয়োগ

Kashikanta MaitraKashikanta Maitra

সঞ্জিত দত্ত, আগস্ট  ২৯: চলে গেলেন নদীয়ার সুসন্তান কাশীকান্ত মৈত্র। আপোষহীন লড়াকু মানুষটির জীবনাবসান হল শনিবার। বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন বৈচিত্রপূর্ণ চরিত্রের মানুষটি। একাধারে বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বাগ্মী, লেখক ও প্রাক্তন মন্ত্রী – এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটি তাঁর বিধানগরের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ৯৬ বছর (জন্ম ১৯২৫, ফেব্রুয়ারি ১৮) বয়সে ।  

শান্তিপুরের বিখ্যাত মৈত্র পরিবারের পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র’র পুত্র তিনি। পিতার মত তাঁর কর্ম জীবনও ছিল বর্ণময়। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত তিনি কৃষ্ণনগর বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত বিধায়ক ছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ভক্ত এবং সমাজতন্ত্রী তরুণ কাশীকান্ত বাবু ১৯৬২ সালে প্রথম প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী হন। এরপর ১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালে সংযুক্ত সোস্যালিস্ট পার্টির প্রার্থী, ১৯৭২ সালে কংগ্রেস এবং ১৯৭৭ সালে জনতা দলের প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের নির্বাচনে জনতা দলের প্রার্থী কাশীকান্ত মৈত্র  পরাজিত হন।

১৯৮২ সালের ১৯ মে নির্বাচনের আগে একটি ঘটনা ঘটে। ১৪ মে নির্বাচন প্রার্থী কাশীকান্ত মৈত্র, কংগ্রেস (জ) প্রার্থী গোপালচন্দ্র সরকার এবং জনতা দলের কর্মী ও কৃষ্ণনগর পুরসভার উপ-পৌরপতি শিবনাথ চৌধুরী নকশাল নেতা রমেন সাহার নেতৃত্বে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক অপহৃত হন।এর প্রতিবাদে ১৬  মে কৃষ্ণনগরে বন্ধ পালিত হয়। ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া নকশালপন্থীরা ভেবেছিল প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে ভোট বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু প্রার্থীর মৃত্যু হলেই একমাত্র নির্বাচন বন্ধ বা স্থগিত হতে পারে সেটা তাদের ধারণায় ছিল না।  পাশাপাশি বিরুদ্ধপ্রার্থী শিবির থেকে ইস্তাহার প্রচার করে বলা হয় পরাজয়ের ভয়ে  তিনি আত্মগোপন করেছেন। এর আগের নির্বাচনে কাশীবাবু অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে যথাসময়েই নির্বাচন হয় এবং তিনি এবার পরাজিত  হন। এই ১৯৮২ সালের পর তিনি রাজনীতির জগত থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।     

বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে বাগ্মীতার জন্য কাশীকান্ত মৈত্র বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে রাজ্যের খাদ্য সংকটের দিগুলিতে সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে দুরন্ত প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন। খাদ্য আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে  নিহত শহীদ ছাত্রের মরদেহ নিয়ে পথে মিছিলে হেঁটেছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন। খাদ্য ও  পশুপালন দপ্তরের মন্ত্রী থাকাকালীন ভূষি কেলেঙ্কারিতে তাঁর আপ্ত সহায়কের নাম তথা দপ্তরের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন।দুর্নীতি প্রমাণে তাঁর ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় গ্রহণে ব্যর্থ হন। আজকের দিনে দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা একটিদল থেকে ভোটে জিতে জার্সি পাল্টে দলবদল করে  অন্য দলে চলে যান। কিন্তু কাশীকান্ত বাবু তা করেননি।আগে দলত্যাগী হয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে এসেছেন। সংবিধান সংশোধনের জন্য যখন ইন্দিরা গান্ধী সংসদে বিল আনেন এবং প্রত্যেকটা বিধানসভা থেকেও পাস করিয়ে নেবার চেষ্টা করেন, সেই সময় কাশীকান্তবাবু  কংগ্রেস দলের সদস্য হয়েও সংবিধান সংশোধন বিলের বিপক্ষে ভোট দেন।

কাশীকান্তবাবু  ব্যক্তিগতভাবে বিধায়কদের পেনশন প্রথার বিরোধী ছিলেন। দুই দশক নিজে বিধায়ক থাকলেও কোনদিন পেনশন না নিয়ে ভারতের সংসদিয়  রাজনীতিতে এক অনন্য নজীর সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি মনে করতেন সমাজসেবার জন্যই রাজনীতিতে আসা।

১৯৫১ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন। ২০২০ সালে লকডাউন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়মিত হাইকোর্টে হাজির থেকেছেন। পুরসভাকর্মী সহ বহু শ্রমিক কর্মচারীর বিপদের দিনে আদালতে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছেন। তিনি আইন বিষয়ে বই লিখেছেন। রাজনৈতিক ভাষ্যকার, প্রাবন্ধিক হিসাবেও গ্রন্থরচনা করেছেন। ‘মার্কসবাদঃ কৃষক ও কৃষিনীতি’ (১৯৮৪), ‘মার্কস ও সমাজতন্ত্র’ (১৯৮৯), ‘রাজনীতি কূটনীতি বিপ্লব’’, ‘মার্কসবাদ লেনিনবাদ মতবাদ ও প্রয়োগে’, ‘মরিচঝাঁপির কান্না’, ‘গণতন্ত্র মুখ মুখোশ’  ইত্যাদি অনেকগুলি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি । রবীন্দ্রসংগীত ছিল তাঁর বড়  প্রিয়। একসময় ভালো গাইতেও পারতেন। 

তাঁর চিকিৎসক পুত্র সুব্রত মৈত্র ১৭ মার্চ ২০১৬সালে প্রয়াত হন। বৃদ্ধবয়সে  পুত্রশোক সহ্য করেও ভেঙে না পড়ে সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। প্রচারবিহীন দাতা কাশীকান্ত মৈত্র সারাবছরই নীরবে অনেক অসহায় মানুষকে  আর্থিক সাহায্য করতেন।তেমনি গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন  শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে  দান করতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিধায়কদের পেনশন প্রথার বিরোধী ছিলেন। দুই দশক নিজে বিধায়ক থাকলেও কোনদিন পেনশন না নিয়ে ভারতের সংশোধীয় রাজনীতিতে এক অনন্য নজীর সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি মনে করতেন সমাজসেবার জন্যই রাজনীতিতে আসা। ২৯ আগস্ট ২০২০ সাধারণ মানুষ হারালেন তাঁদের একজন প্রিয়জনকে আর নদীয়া তথা বাংলা হারালো তার এক কৃতী সন্তানকে।

Share the news