নশীপুর-আজিমগঞ্জ রেলসেতু: উত্তরবঙ্গে যাওয়ার বিকল্প রেলপথের জমি জট খুলতে চলেছে

সঞ্জিত দত্ত

অবশেষে জমি জট খুলতে চলেছে নশীপুর-আজিমগঞ্জ রেলপথের। মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদীর উপর দিয়ে তৈরী হওয়া এই রেলপথের মাধ্যমেই উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণ বঙ্গের বিকল্প রেল যোগাযোগের সূত্রপাত এখন কার্যতই সময়ের অপেক্ষা।

নশীপুর আজিমগঞ্জ সেতুটি চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেলপথের দূরত্ব কমবে প্রায় ২১ কিমি। স্বাভাবিক ভাবে যাত্রাপথের সময়ও কমবে অনেকটা।

আগামী ১ নভেম্বর থেকে থেমে যাওয়া কাজ আবার শুরু হবে বলে রেল সূত্রে জানা যাচ্ছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে।আর ২০২৩ সালের মার্চ মাসের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে তাঁরা আশা করছেন।

বিগত কয়েক বছর যাবত ভাগীরথী নদীর বুকের উপর অলঙ্কারের মতো রেলসেতু তৈরি হয়ে ঝুলে আছে। কিন্তু স্টেশন থেকে রেলসেতু পর্যন্ত রেল ট্র্যাক নির্মাণ করা যায়নি জমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে নানা জটিলতায়।

নশীপুর আজিমগঞ্জ রেলপথটি চালু হয়ে গেলে আগামী দিনে শিয়ালদহ এবং কলকাতা স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেল সহ বিভিন্ন মেল এক্সপ্রেস ট্রেন এই পথে যাতায়াত করবে, এমনই সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন রেল কর্তারা। এমনকি এই বিকল্প পথ চালু হলে শিগগিরই বহরমপুর স্টেশন থেকেও যাত্রা শুরু করতে পারে উত্তর বঙ্গের নতুন কিছু ট্রেন।

এখন হাওড়া থেকে আজিমগঞ্জ হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি রেল পথের দূরত্ব ৫৬৭ কিমি। অন্যদিকে শিয়ালদহ থেকে আজিমগঞ্জ  হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দূরত্ব ৫৭৪ কিমি। আর হাওড়া থেকে বোলপুর, রামপুরহাট হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দূরত্ব ৫৭৩ কিলোমিটার।নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেলপথ চালু হলে শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দূরত্ব প্রায় ২১ কিমি কমে গিয়ে দাঁড়াবে ৫৫৩ কিলোমিটার।

বর্তমানে দার্জিলিং মেল শিয়ালদহ থেকে বর্ধমান, বোলপুর শান্তিনিকেতন, (রামপুরহাট ফারাক্কা পথে) মালদহ, কিষানগঞ্জ হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি যায়।

গত ১৫ আগস্ট ২০২২ থেকে দার্জিলিং মেলের যাত্রাপথ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়ি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। যে কোন রেল প্রকল্পে নতুন লাইন নির্মাণের সময় প্রস্তাবিত পথের গাড়ি চলাচলের একটি সম্ভাব্য টাইম টেবিল তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে ২০১৭ সালে নশীপুর আজিমগঞ্জ পথের জন্য যে টাইমটেবিল করা হয় তাতে শিয়ালদহ, রাণাঘাট, কৃষ্ণনগর, বহরমপুরকোর্ট, মালদহ টাউন, কিষানগঞ্জ হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত মাঝে পাঁচটি হল্ট স্টেশন রাখা হয়েছে। গড়ে ৫৯ কিমি গতিতে যাত্রা করে শিয়ালদহ থেকে রাত ২২টা ৩৫মিঃ ছেড়ে সকাল ৬ টায় নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে।

তাই জমি জট কাটতেই নতুন পথে উত্তর বঙ্গ সফরের স্বপ্ন দেখছেন দক্ষিণ বঙ্গের অধিবাসীরা।

১৯০৫ সালে নির্মিত রাণাঘাট কৃষ্ণনগর লালগোলা শাখার রেলপথ চালুর পর নশীপুর রোড স্টেশনের থেকে একটি রেলপথ ও ভাগীরথীর উপর সেতু নির্মাণ করে গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে নলহাটি স্টেট রেলওয়ের (১৮৭২) আজিমগঞ্জ স্টেশনের মধ্যে সংযোগ ঘটানো হয়। ১৯২২-২৩ সালের রেল মানচিত্রে এই সেতুর অবস্থান দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) অজ্ঞাত কারণে সেতুটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বা পরিত্যক্ত হয়।

দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ তথা উত্তর ভারতের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথ ও সেতু পুনরুদ্ধারের জন্য ১৯৯০এর দশকের গোড়ার দিকে নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদের মানুষ আন্দোলনে নামেন। মুর্শিদাবাদে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মী এ আর খান-এর নেতৃত্বে প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন, প্রয়াত কিশোরীমোহন দাস ও প্রয়াত বিশ্বজিৎ দাসের নেতৃত্বে নদীয়ার রেলওয়ে যাত্রী সমিতি আন্দোলনে সামিল হয়। আন্দোলনের নানাস্তরে তাঁরা সাংসদ অজয় মুখোপাধ্যায় (১৯৮৯-৯৯), অসীম বালা (১৯৯৪-৯৯), প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়  (১৯৯৪-৯৯), সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (১৯৯৯-২০০৪), অধীর রঞ্জন চৌধুরী (১৯৯৯- বর্তমান), জ্যোতির্ময়ী সিকদার (২০০৪-০৯) এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় (২০০৪-২০১২) এর মাধ্যমে বারংবার কেন্দ্রের কাছে দাবী পৌঁছে দেন। রেলের বোর্ডের চেয়ারম্যান সাংসদ মনোরঞ্জন ভক্ত স্থান পরিদর্শন করে যান। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ২০০০ সালে রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকল্পের অনুমোদন দেন।

২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর জিয়াগঞ্জের কাছে ভট্টপাড়ায় প্রণব মুখোপাধ্যায়, অধীর রঞ্জন চৌধুরীদের উপস্থিতিতে রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। ২০০৬ সালে প্রাথমিক নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৭৮৫ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ সহ ২০১৬ সালের মধ্যে কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেলেও কাজে বিঘ্ন ঘটে।

স্থানীয় মানুষদের লাভ যেটা হয় তা হল নব নির্মিত সেতুর উপর দিয়ে  পায়ে হেঁটে বা সাইকেল সঙ্গে করে হেঁটে সেতুর উপর পায়ে চলার জন্য বরাদ্দ পথ দিয়ে বিনা পয়সায় নদী পারাপার করতে থাকেন। ২০১৫র পর তিনবছরে সেতুর সংযোগ স্থলকে ছুঁতে কিছুটা মাটি, সামান্য কিছু স্টোন ডাস্ট  ফেলা হয়। 

কিন্তু ২০১৮ সালে মাহিনগরে প্রায় তিনগুণ বেশী দামে জমি অধিগ্রহণের পরও চাকরির দাবি ইত্যাদিতে কাজ আবার বন্ধ হয়ে যায়। সামান্য ৭ একর জমি নিয়ে সমস্যা মিটেও মিটছিল না। এবার প্রশাসন দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে চলেছে বলে জানা গেল।

কেন্দ্র থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়ে নির্দেশ পৌঁছিয়েছে। মুর্শিদাবাদের জেলা শাসক রাজর্ষি মিত্র কাজের অগ্রগতির স্বার্থে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণের ঈঙ্গিত দিয়েছেন। গত ২০ আগস্ট ২০২২ পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান অধীর রঞ্জন চৌধুরী ও অন্যান্য আধিকারিকরা প্রকল্প স্থান পরিদর্শন করেন।

প্রশাসনিক আধিকারিকদের মতে প্রাক্তন রেল মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকল্পের অনুমোদন প্রদানকালে দু’টি ভুল করেছিলেন। প্রথমত: পুরাতন রেলট্র্যাককে ব্যবহার না করে এক কিলোমিটার মত উত্তরদিকে নতুন রেলট্র্যাক নির্মাণ। এরফলে নতুন করে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্ন এসে যায়। পুরাতন রেলট্র্যাককে  কাজে লাগালে শুধু নদীর উপর সেতুর স্থান সামান্য পরিবর্তন করলেই সমস্যা মিটে যেত। উত্তরবঙ্গে বন্যায় রেলসেতু ভেঙ্গে যাওয়ার পর উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেল এভাবে বহুবার করেছে।

দ্বিতীয়ত: তিনি জমিদাতাদের পরিবারের একজনকে চাকরি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা রেলের আইন বিরুদ্ধ। রেল আইনে চাকরির দেওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র জমির মূল্যবাবদ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এই দুই ভুলের প্রতিক্রিয়ায় জমি জটিলতায় কাজ বারবার থমকে যায়।

কিন্তু এবার কেন্দ্রীয় সরকারের কড়া নির্দেশ কাজ শেষ করতে হবে অবিলম্বে। কাজ শেষ করার ডেড লাইনও বেঁধে দেওয়া হয়েছে।চাওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের সহযোগিতা।

এবার ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নেওয়া যাক দার্জিলিং মেলের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের সাথে রেল যোগাযোগের সূত্রপাতের গল্প।

ভারতের প্রাচীন ট্রেনগুলির মধ্যে দার্জিলিং মেল একটি। ১৮৬৯ সালে শিয়ালদহ (তখন কলকাতা স্টেশন বলা হতো) থেকে রাণাঘাট হয়ে দামুকদিয়া (১৮৫ কিমি) যেত। এখান থেকে যাত্রীরা নৌকায় নদী পার হয়ে মিটারগেজ রেলপথে ৩৩৬ কিমি যাত্রা করে শিলিগুড়ি স্টেশনে পৌঁছাতো। ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ এবং ১৯২৬ সালে মিটারগেজকে ব্রডগেজে রূপান্ত্রের পর দার্জিলিং মেল রাণাঘাট হয়ে শিলিগুড়ি যেত। এছাড়াও এই পথে পার্বতীপুর এক্সপ্রেস, আসাম মেল ইত্যাদি আরও কিছু গাড়ি যাতায়াত করতো। দেশভাগের পর বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর এই পথে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে ফারাক্কায় রোড কাম রেল ব্যারেজ তৈরি হওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর মনিহারী ঘাট, খেজুরিয়া ঘাট হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে যাত্রীদের উত্তরবঙ্গে যেতে হতো। তারও আগে বৃটিশ আমলে ১৯০৭ সালের পর লালগোলাঘাট দিয়ে নৌকায় পদ্মানদী পার হয়ে অন্যদিকে লালমণিঘাট হয়ে উত্তরবঙ্গে যাওয়া যেত।

তাই ১৮৬২ সালে চালু হওয়া শিয়ালদহ রাণাঘাট শাখায় আবার দার্জিলিং মেলের মতো গাড়ি চলাচলের সংবাদে নদীয়ার মানুষ আপ্লুত। পাশাপাশি মুর্শিদাবাদের মানুষও আনন্দিত। এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হলে এই পথের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে।   রাণাঘাট লালগোলা সেকশনে ডাবল লাইন, বৈদ্যুতিকীরণের কাজ সহ আধুনিকীরণের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন শুধু সামান্য সময়ের অপেক্ষা নতুন পথে উত্তর বঙ্গ সফরের।

Share the news