চাপড়ায় নির্মলেন্দু বিশ্বাস স্মরণোৎসব: আলোচনায়-সংগীতে উন্মোচিত স্মারকগ্রন্থ

Cover of the Souvenir

 


দীপাঞ্জন দে

কবি, গীতিকার-সুরকার, সংগীতশিল্পী ও সংগীতশিক্ষক নির্মলেন্দু বিশ্বাস (১৯৩৯—২০২১) (Nirmalendu Biswas) ছিলেন চাপড়া জনপদ ও তার বিস্তৃত অঞ্চলে সংগীতচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আনার অন্যতম পথিকৃত। তাঁর উদ্যোগে সংগীতশিক্ষার যে সুনির্দিষ্ট ভিত্তি গড়ে ওঠে, তা আজও স্থানীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মূল ভরসা। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সংগীতচর্চার পীঠস্থান ‘গীতিকুঞ্জ’। পাশাপাশি নদিয়া জেলার নানা প্রান্তে একাধিক সংগীত-শিক্ষায়তনের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক হিসেবে তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। কাব্যচর্চায়ও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। ‘অভিসারে উদাসীন’, ‘গোরস্থান’, ‘শ্মশান’, ‘অপরূপা কমলিনী’— তাঁর এই উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি যেমন ভাবগত বৈচিত্র্যের সাক্ষ্য দেয়, তেমনই প্রকাশ করে তাঁর তীব্র সংবেদনশীলতা। চিত্রাঙ্কনেও ছিল তাঁর একান্ত অনুরাগ, আর তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলি আজ সংগ্রহযোগ্য শিল্পকর্ম হিসেবেই বিবেচিত। পোশাকে-আশাকে নিরাভরণ বাঙালি, সৌজন্যে অমায়িক, স্বভাবে বাউলসুলভ; আপাদমস্তক শিল্পী এই অজাতশত্রু মানুষটির স্মৃতির উদ্দেশে তাঁর অনুরাগীদের শ্রদ্ধা একত্র হয়েছে ‘সুরসাধক কবি নির্মলেন্দু বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ’-এ।

মহালয়ার দিন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রবিবার বিকেলে চাপড়ার ভীম লজে ‘নির্মলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতিরক্ষা কমিটি’-র উদ্যোগে এই স্মারকগ্রন্থের প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার বিশাল এই গ্রন্থের প্রকাশক স্মৃতিরক্ষা কমিটি, আর পরিবেশনার দায়িত্ব গ্রহণ করে কৃষ্ণনগর গবেষণা পরিষৎ। গেটওয়ে গ্রাফিক্স করেছে অলংকরণ ও মুদ্রণ। গ্রন্থের সম্পাদক দীপাঞ্জন দে, সহকারী সম্পাদক রামকৃষ্ণ দে, আর প্রচ্ছদ এঁকেছেন বাঁকুড়ার প্রখ্যাত ভাস্কর উপলকান্তি সাহা। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও নির্মলেন্দু বিশ্বাসের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। প্রদীপ প্রজ্জ্বালন করেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও কবি নূরউদ্দিন বিশ্বাস; আর মাল্যার্পণ করেন নির্মলেন্দু বিশ্বাসের বিশেষ প্রীতিভাজন, সংস্কৃতিপ্রেমী পিন্টু চক্রবর্তী।

উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে পরিবেশিত হয় নির্মলেন্দু বিশ্বাসের রচিত ও সুরারোপিত গান “জাগো রে সবাই চেয়ে দেখো ওই দুয়ারে ভোরের আলো”। গানটি পরিবেশন করেন নন্দদুলাল বিশ্বাসের গানের ক্লাসের শিক্ষার্থী সৃজিতা বিশ্বাস, অমৃতা সাধুখাঁ, তৃষা মণ্ডল ও অন্বেষা দত্ত। স্বাগত ভাষণে নির্মলেন্দু বিশ্বাসের কনিষ্ঠ পুত্র দেবদুলাল বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট সকলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এই প্রকাশনা আসলে পুণ্যময় মহালয়ার দিনে এক অনন্য পিতৃতর্পণেরই উপলক্ষ।

স্বাগত বক্তব্যের পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্মারকগ্রন্থের আবরণ উন্মোচন করেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও লেখক সনাতন বিশ্বাস, তাঁর সঙ্গে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুরঞ্জন মণ্ডল এবং সংগীত-প্রশিক্ষক সামসের আলি বিশ্বাস। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সম্পাদক দীপাঞ্জন দে, সহকারী সম্পাদক রামকৃষ্ণ দে, প্রকাশক নন্দদুলাল ও দেবদুলাল বিশ্বাস, স্মৃতিরক্ষা সমিতির সদস্য কবি রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সংগীতশিল্পী কার্তিক পাল, কবি-প্রাবন্ধিক অম্বিকা দে, লোকসংগীতশিল্পী সাধন পাত্র প্রমুখ।

গ্রন্থ প্রকাশের পর সম্পাদক দীপাঞ্জন দে গ্রন্থের নির্মাণ প্রক্রিয়া ও বিষয়বস্তুর সারাংশ তুলে ধরেন। উদ্বোধক সনাতন বিশ্বাসও তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে স্মারকগ্রন্থটির প্রশংসা করেন। গ্রন্থে যাঁরা নির্মলেন্দু বিশ্বাসকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন, এমন সত্তর জন লেখকের প্রত্যেকের হাতে সৌজন্য কপি ও বিশেষ স্মারক তুলে দেওয়া হয়। এই পর্বে সহযোগিতায় ছিলেন প্রবীণ সাহিত্যানুরাগী কাঞ্চন চৌধুরী, কবি রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কবি অমৃতাভ দে, রোশনী হালসানা, সুরসাধকের পুত্রবধূ মিঠু বিশ্বাস, কন্যা স্বপ্না মণ্ডল, পৌত্র দেবরূপ বিশ্বাস প্রমুখ।

এরপর পরিবেশিত হয় নির্মলেন্দু বিশ্বাসের জনপ্রিয় ভক্তিগান “কত আশা নিয়ে এসেছি পরমেশ তোমারি চরণ তলে”, গেয়েছেন তাঁর সংগীত-বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী গোপা চৌধুরী। রামকৃষ্ণ দে তাঁর বক্তৃতায় স্মারকগ্রন্থ নির্মাণের নানা পর্যায়ের কথা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের শেষভাগে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন নির্মলেন্দু বিশ্বাসের জ্যেষ্ঠপুত্র ও প্রকাশক সংগীতশিক্ষক নন্দদুলাল বিশ্বাস। সমাপ্তি সংগীত হিসেবে পরিবেশিত হয় নির্মলেন্দু বিশ্বাসের রচিত ও সুরারোপিত “বেদনা ভরা অশ্রু দিয়ে আমরা গেঁথেছি মালা আজি তোমার বিদায়বেলা”, গেয়েছেন নন্দদুলাল বিশ্বাসের গানের ক্লাসের শিক্ষার্থীরা। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা ছিল কবি রামকৃষ্ণ দে ও রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দক্ষ ব্যবস্থাপনায়।

লেখক: সম্পাদক, ‘সুরসাধক কবি নির্মলেন্দু বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ

Share the news