নিজেকে হাড়ে হাড়ে ‘বাঙ্গালী’ দাবী করা ব্যক্তিও মাথা চুলকান বাংলা মাস আর তারিখ জিজ্ঞেস করলে। আসলে নিত্য অপ্রয়োজনে অনভ্যাস। বঙ্গজীবনে এখন মনে রাখা বাংলা দিনতো আসলে দুটি। নববর্ষ, মানে ১লা বৈশাখ। আর ২৫শে বৈশাখ। রবি ঠাকুরের জন্মদিন। বাকি দিন গুলো মনে রাখা বিষম দায়।কিন্ত,বাস্তবিকভাবে নিত্য ব্যবহারিক কারনে যদি বাংলা বর্ষ আর ইংরেজী বর্ষের একটা সমন্বয় করা যেত তাহলে উপকৃত হত বঙ্গ সংস্কৃতি। বরং প্রতিবেশী বাংলাদেশ চেষ্টা করেছে…এপার বঙ্গে আমরা বাংলা ইংরাজি সাল তারিখের সমন্বয় ঘটাতে না পারলেও বাংলাদেশ কিন্তু সংস্কার করে সমন্বয় সাধন করেছে এই দুইয়ের। আর সেই সমন্বয়ের ফল বাংলাদেশে নব বঙ্গ বর্ষ এখন চিরস্থায়ী ভাবে ১৪ এপ্রিল পালিত হয়। বাংলা ইংরেজী সাল তারিখের গোলকধাঁধায় পথ খুঁজলেন সঞ্জিত দত্ত।
শহরের চায়ের দোকানে প্রতিদিনের আড্ডায় তর্ক, রসিকতা চলছে। একজন দুম করে বলে বসলেন, ‘বলুন তো আজ বাংলার কত তারিখ?’ উত্তরদাতা মাথা চুলকাটে চুলকাতে বললেন ‘বাংলাটা ঠিক আসে না রে ভাই। ইংরেজি তারিখটাই লিখি তো।’ অন্যজন নিদান দিলেন ‘আরে খবরের কাগজের মাথাটা দ্যাখ না’।
বাঙালির সবচেয়ে চেনা দিন দু’টি – পহেলা বৈশাখ এবং পঁচিশে বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ মানে বাংলা নববর্ষ দিবস। আর পঁচিশে বৈশাখ রবি ঠাকুরের জন্মদিন। এই দুটি দিন বাদে কিছু মানুষ ইদানীং ১১ই জ্যৈষ্ঠ বা ২২শে শ্রাবণের কথা উচ্চারণ করেন। তবে তা হাতে গোনা কিছু মানুষ। বঙ্গ জীবনে আসলে বাংলা দিন ঐ দুটিই। রসিক কৃষ্ণনাগরিক রায়দা বলেন বাঙালি একবছরে দু’টি নববর্ষ পালন করে। একটা গরম নববর্ষ, অন্য ঠান্ডা নববর্ষ।১ জানুয়ারি ঠান্ডায় হট ড্রিংক্স আর গরমকালে পহেলা বৈশাখ বাঙালি মজে যায় দইয়ের ঘোল সরবতে।
কিন্তু, বাস্তবিক অর্থেই বাঙালি ঘোল খেয়ে যায় ইংরেজি আর বাংলা তারিখের হিসাব মেলাতে গিয়ে।ইংরেজি সালের কোন মাসে কত দিন তার একটা সূত্র ছাত্ররাও জানে। ইংরেজি মাস মূলতঃ ৩০ আর ৩১ দিনের। কিন্তু, বাংলার চলে যাওয়া বঙ্গাব্দের কোন মাস ৩২ দিনে ছিল, তা জিজ্ঞেস করলে এক্ষুনি চুল ছিঁড়তে শুরু করবে অধিকাংশ বাঙ্গালী। তাই বাংলা ক্যালেন্ডারে ২৯,৩০,৩১ বা ৩২ দিনের মাস দেখলে সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়।
আমাদের দেশে অনেকরকম বর্ষ বা সাল চালু রয়েছে। বিক্রম সংবৎ,শকাব্দ বা শালীবাহনাব্দ,গুপ্তাব্দ,শশাঙ্কাব্দ, ভাস্করাব্দ, বঙ্গাব্দ, হিজরি সন, শ্রীচৈতন্যাব্দ বা গৌরাব্দ ইত্যাদি। এর কোনটা চন্দ্রবর্ষ আবার কোনটা সৌরবর্ষ। সময়, কাল, মাস, বর্ষ গণনায় চন্দ্র ও সূর্য্য কোনটাকেই অস্বীকার করা হয়না। কিন্তু এই দুয়ের আবর্তনকালের ভিন্নতায় দিবস, মাস, বর্ষ গণনায় জটিলতা দেখা দেয়।
বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন সৌরবর্ষ বা সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। বঙ্গাব্দের সূচনাকাল সম্পর্কে নানা মত আছে। তবে বঙ্গাব্দের সূচনার পিছনে চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের দ্বন্দ্ব অনেকটাই কাজ করেছে বলে মনে হয়। আমাদের দেশ কৃষি নির্ভর দেশ। কৃষিকাজ চাষাবাদ আবার চন্দ্র নয় সৌর আলোকের উপর নির্ভরশীল। সৌরবর্ষের ঋতু বিভিন্নতায় কৃষিপণ্যের উৎপাদনে বৈচিত্র্য আসে। চান্দ্র বর্ষে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। রাজস্ব প্রদান, সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠান, পারিবারিক-সামাজিক আর্থিক অবস্থান সবকিছুকে প্রভাবিত করে এই কৃষি।
ইংরেজি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা মাসের শুরুটা অসুবিধা সত্বেও স্বীকার করে নিতে হয়। কিন্তু গণ্ডগোল বাধে অন্য জায়গায়| বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মানূষের প্রয়োজনেই বার বার পঞ্জিকা সংস্কার হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন বঙ্গাব্দে বাংলা ও ইংরাজি তারিখে সমন্বয় ঘটানো যাবে না কেন? ভারতে বাংলা ইংরাজি তারিখে সমন্বয় ঘটানো না গেলেও বাংলাদেশ কিন্তু সংস্কার করে সমন্বয় সাধন করেছে। দাবি তুলুন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী বা ইংরাজি সালের তারিখের সঙ্গে বঙ্গাব্দের দিন বা তারিখের বিজ্ঞানসম্মত সমন্বয় করা হোক।
মোগল রাজত্বের শুরুতে হিজরি সন অনুসারে কাজকর্ম চলত। হিজরি সন আসলে ইসলামী চান্দ্রবর্ষ। চান্দ্রবছর সৌরবছরের থেকে ১১/১২ দিন কম হয়। সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ দিন। ফলে নানা বাস্তব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সম্রাট আকবর (রাজত্ব ১৫৫৬-১৬০৫) তাঁর প্রশাসনিক আমলাদের অনুরোধে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হন। তিনি আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজীকে দায়িত্ব দেন এই সমস্যা মিটিয়ে একটা কমন বর্ষবিন্যাস করতে।
আকবরের আমলে দিল্লি, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, দাক্ষিণাত্য, তামিলনাডুতে শকাব্দ, কেরলে কোলবর্ষম, বাংলায় লক্ষণাব্দ, শশাঙ্কাব্দ, গুপ্তাব্দ ইত্যাদি নানা ধরণের সাল বা সন প্রচলিত ছিল। চালু হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকাকে ইরানের ১০৭৯ খৃষ্টাব্দ থেকে প্রচলিত ”জেলালি সৌর পঞ্জিকা” অনুসরণে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটি ‘তারিখ-ই-এলাহী’ বা ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি চলতি হিজরি সনকে সৌরসনে রূপান্তর ঘটালেন। প্রথমে আরবীয় নাম রাখলেও পরে দেশীয় শকাব্দ, বিক্রম সংবৎ ইত্যাদি সৌরসনে ব্যবহৃত মাস এবং বারের নাম, যেমন মাস বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্ত্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন,চৈত্র এবং বার সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রবি অপরিবর্তিত রাখা হল।
আকবর ‘ফসলি সন’ যেবার চালু করেন সেবার ছিল ৯৬৩ হিজরি সন (১৫৫৬খৃ)। নতুন ফসলি সনের গণনা শুরু হল ৯৬৩ থেকে। অন্য অভিমত ৫৯৪ খৃষ্টাব্দে প্রাচীন বঙ্গের রাজা শশাঙ্ক এর সিংহাসনে আরোহণের সময় বঙ্গাব্দের সুচনা। ভাস্কর বর্মণের রাজ্যে প্রচলিত ভাস্করাব্দ এর অনুকরণে শশাঙ্ক শশাঙ্কাব্দ চালু করেন। দুটি সময়ের সঙ্গেই হিসাবে বর্তমান সাল মিলে যায়। ৫৯৪+(যোগ) ১৪২৫ (বর্তমান বাংলাসন)=২০১৯ খ্রিস্টাব্দ আবার ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ৯৬৩ হিজরি = ৫৯৩+(যোগ) ১৪২৫/ ১৪২৬ (বাংলা সন) = ২০১৮/২০১৯ খ্রিস্টাব্দ।
সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গাব্দের উৎস কথা’ এবং ভাষাবিদ রহমতুল্লাহ বাঙ্গালী তাঁর ‘বঙ্গাব্দের জন্মকথা’ গ্রন্থে রাজা শশাঙ্ককেই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইংরেজি সাল মানে খ্রিস্ষ্টাব্দ, যার ভিত্তি গ্রেগরীয় সৌরবর্ষ। ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ গ্রোগোরি ত্রয়োদশ এর এক আদেশানুসারে এই বর্ষপঞ্জীর প্রচলন ঘটে। ৪৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার কর্তৃক প্রবর্তিত জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি এবং ইস্টারের তারিখ নির্ণয়ের জন্য গির্জায় ব্যবহৃত চান্দ্র পঞ্জিকার সংস্কার করে এই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর সৃষ্টি। ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে সরকারিভাবে এই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের দেশে আমরা কাজে কর্মে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর মাস, তারিখ ও বার ব্যবহার করি। যদিও ইংরেজি সালের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জীর মাস ও বারের নামের ভিন্নতা রয়েছে। এই দ্বিত্বস্বত্ত্বা আমরা মেনেও নিয়েছি সংখ্যার দিক থেকে এক বলে।
ইংরেজি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা মাসের শুরুটা অসুবিধা সত্বেও স্বীকার করে নিতে হয়। কিন্তু গণ্ডগোল বাধে অন্য জায়গায়। কোন একটা বাংলা তারিখ প্রতি বছর একই ইংরাজি তারিখে পড়ে না। ১লা বৈশাখ কখনও ১৪ এপ্রিল, কোনবার ১৫ এপ্রিল পড়ে। যেমন এবার, অর্থাৎ ১৪২৬ এর শুরু হল ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ ইংরাজি ১৮৬১ সালে ৭ মে ছিল। এখন পড়ে ৮ অথবা ৯ মে। তেমনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিন ৪ঠা শ্রাবণ। ১৮৬৩ সালে ছিল সেদিন ছিল ১৯ জুলাই।এখন ১৮,১৯,২০ বা ২১ জুলাই পড়ে। ২০জুলাই ছিল ২০০৮, ২০১২, ২০১৬ সালে, ২১ জুলাই ২০১১, ১৩, ১৪, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০১৯ সালে। কৃষ্ণনগরে বাংলা তারিখ ধরে ৪ঠা শ্রাবণ তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। কিন্তু সরকারি তালিকায় পালনীয় দিবস হিসাবে ১৯ জুলাই ধরা হয়। ফলে বিভ্রান্তির শেষ থাকেনা।
১৯৫০ সালে একটা জাতীয় অব্দ প্রচলনের চিন্তা করেন ভারত সরকার। এর জন্য বিজ্ঞানী ড.মেঘনাথ সাহার নেতৃত্বে একটি “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” (Calendar Reform Committee) গঠন করা হয়। ভারতে ৭৮ খৃষ্টাব্দ থেকে প্রচলিত প্রাচীন সৌর অব্দ শকাব্দকে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে ঋতুনিষ্ঠ ও সবর্স্তরে ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে উদ্যোগী হন তাঁরা। ১৯৫৭ সালের ২২ মার্চ (১ চৈত্র ১৮৭৯ শক) ভারত সরকার এই সংস্কারপ্রাপ্ত শকাব্দকে ভারতের জাতীয় অব্দ হিসাবে গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সবর্স্তরে গ্রেগোরিয়ান অব্দের সাথে “ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের” ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। শকাব্দের নববর্ষ ধরা হয় ১ চৈত্র (২১/২২ মার্চ)। কিন্তু সংস্কারকৃত শকাব্দ উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বঙ্গাব্দের সঙ্গেও ফারাক থেকে যায়। নানা সময়ে বাংলা নববর্ষ চৈত্র, অগ্রহায়ণ (অগ্র-হায়ণ), মাঘ (মার্গশীর্ষ), আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদি মাস থেকে ধরা হত। ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ আর্থিক বছর ধরা হলেও রাজ্য ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের খাজনা আদায় ১লা বৈশাখ থেকে চৈত্র সংক্রান্তি হিসাবে করা হয়।
ভারতে বাংলা ইংরাজি তারিখে সমন্বয় ঘটানো না গেলেও বাংলাদেশ কিন্তু সংস্কার করে সমন্বয় সাধন করেছে। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে বাংলা সন সংস্কার কমিটি গঠন করে সংস্কার কাজে অগ্রণী হয়। ড.মেঘনাথ সাহার সুত্র ধরেই বাংলা বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ হতে ভাদ্র) ৩১ দিন; বাকি সাত মাস (আশ্বিন হতে চৈত্র) ৩০দিন হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। চার বছর অন্তর অধিবর্ষ বা লিপইয়ার হলে ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। ইংরাজি সালে ফেব্রুয়ারি মাসে লিপইয়ার ধরা হয়। আর এখানে ফাল্গুন মাস ফেব্রুয়ারিতেই পড়ে। বাংলাদেশে এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখকে বছরের প্রথমদিন নির্দিষ্ট করেই হিসাব করা হয়। আমাদের নতুন শকাব্দে চৈত্র মাসকে প্রথম মাস ধরে লিপইয়ারের বছরে সেই মাসে ১দিন যোগ করে ৩০+১=৩১ দিনের নিদান দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দেশে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালিত হয় চান্দ্র পঞ্জিকা মতে। ১৮৯০সাল (১২৯৭ বঙ্গাব্দ) থেকে প্রকাশিত এবং গণিতজ্ঞ মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত পঞ্জিকা ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’টি “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” র বিজ্ঞানভিত্তিক গণনার সাথে সম্পূর্ণ এক রাখা হয়। এছাড়াও বাজারে আরো অনেক পঞ্জিকা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়। এই সব পঞ্জিকার বিক্রিও যথেষ্ট ভালো। তাদের গণনার ভিন্নতায় মাঝে মধ্যে হাস্যকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। এই সব পঞ্জিকাকারগণ কিন্তু ইংরেজি আর বাংলা তারিখের হিসাব মেলানোর কোন চেষ্টা করেন না। শুধুমাত্র সংবৎ, হিজরি বা অহমিয়া তারিখ উল্লেখ করেন। ফলে সাধারণের সমস্যার কোন সমাধান হয়না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মানূষের প্রয়োজনেই বার বার পঞ্জিকা সংস্কার হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন বঙ্গাব্দে বাংলা ও ইংরাজি তারিখে সমন্বয় ঘটানো যাবে না কেন? বিশেষ করে বাংলাদেশে যদি তা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। চান্দ্র পঞ্জিকামতে অন্নপ্রাশন, বিবাহ, উপবাস, পূজা, গৃহপ্রবেশ, ব্যবসার শুরু ইত্যাদি যেমন চলছে চলতেই পারে, তার নিজের মতো। হিজরি সন মোতাবেক ইসলাম ধর্মীয় পালনীয় প্রথা পালিত হয় ইসলামী পঞ্জিকা ধরে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব, শাক্ত বা অন্যান্য হিন্দুরা তাঁদের সম্প্রদায়গত নিয়মে তিথি নক্ষত্র অনুসারে পালন করেন। কোন সংঘাত নেই।
বাংলা ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কিছু ব্যক্তি বা সংগঠন ভাবনা চিন্তা চর্চা করেন। এই নিয়ে নানা আন্দোলনে সামিল হন। বাংলাদেশের পাশাপাশি যাদবপুর, বহরমপুর এর মতো এপার বাংলার কিছু স্থানে ১লা বৈশাখ অসাম্প্রদায়িক উৎসব ‘বাংলা নববর্ষ’পালন করেন। বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল আর ভারতে ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ। অর্থাৎ ১লা বৈশাখ পালনের সময় দিন বিভ্রাটে বিব্রত বোধ করেন।
বাংলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের কাছে আবেদন আপনারা এগিয়ে আসুন। দাবি তুলুন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী বা ইংরাজি সালের তারিখের সঙ্গে বঙ্গাব্দের দিন বা তারিখের বিজ্ঞানসম্মত সমন্বয় করা হোক। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বাংলাদেশে যে সূত্র বা পদ্ধতিতে এই সামঞ্জস্য করা হয়েছে সেটা প্রয়োগ করাই সঠিক হবে। বাংলার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এটা খুব জরুরী।[]
বাংলাদেশে সংস্কারকৃত বঙ্গাব্দ(পঞ্জিকার)মাস, দিন সংখ্যা এবং ভারতে প্রচলিত (সনাতন) বঙ্গাব্দের দিন সংখ্যা
মাস |
দিন
(সংস্কারকৃত) |
দিন (সনাতন) |
ঋতু |
নামকরণের সূত্র(নক্ষত্র) |
রাশি |
বৈশাখ |
৩১ | ৩০/৩১ | গ্রীষ্ম | বিশাখা |
মেষ রাশি |
জ্যৈষ্ঠ |
৩১ | ৩১/৩২ | গ্রীষ্ম | জ্যেষ্ঠা |
বৃষ রাশি |
আষাঢ় |
৩১ | ৩১/৩২ | বর্ষা | উত্তরাষাঢ়া |
মিথুন রাশি |
শ্রাবণ |
৩১ | ৩১/৩২ | বর্ষা | শ্রবণা |
কর্কট রাশি |
ভাদ্র |
৩১ | ৩১/৩২ | শরৎ | পূর্বভাদ্রপদ |
সিংহ রাশি |
আশ্বিন |
৩০ | ৩১/৩০ | শরৎ | অশ্বিনী |
কন্যা রাশি |
কার্ত্তিক |
৩০ | ২৯/৩০ | হেমন্ত | কৃত্তিকা |
তুলা রাশি |
অগ্রহায়ণ |
৩০ | ২৯/৩০ | হেমন্ত | মৃগশিরা |
বৃশ্চিক রাশি |
পৌষ |
৩০ | ২৯/৩০ | শীত | পুষ্যা |
ধনু রাশি |
মাঘ |
৩০ | ২৯/৩০ | শীত | মঘা |
মকর রাশি |
ফাল্গুন |
৩০/৩১ | ২৯/৩০ | বসন্ত | উত্তরফাল্গুনী |
কুম্ভ রাশি |
চৈত্র |
৩০ | ৩০/৩১ | বসন্ত | চিত্রা |
মীন রাশি |
লেখক পরিচিতি: সঞ্জিত দত্ত প্রাক্তন গ্রন্থাগারকর্মী।নিবাস কৃষ্ণনগর , নদীয়া । সংবাদ সাপ্তাহিক “গ্রাম গ্রামান্তর” পত্রিকার ২৫ বছর অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন । সম্পাদনা করেছেন ‘তীরন্দাজ নাট্যপত্র’, ‘রঙ বেরঙের আড্ডা’। নিত্য রেল যাত্রী হিসাবে রেল চর্চা সঞ্জিত বাবুর প্রিয় বিষয়। লিখেছেন “আনন্দবাজার পত্রিকা”, “সংবাদ প্রতিদিন”, “কালান্তর”, “এশিয়ান এজ” দৈনিকে ও newsfromnadia.in । নদীয়া তথা স্থানীয় ইতিহাস চর্চার কাজে নিয়োজিত । প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘মায়াপুরঃ অতীত ও বর্তমান’ , ‘অঞ্জনা নদী তীরে ‘, ‘ফুলডোরে বাঁধা নদীয়া ও রবীন্দ্রনাথ’ | সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘সেতার’, ‘অ-শোক জীবন তিন ভুবন’, ‘কবিতার অলিন্দে জীবনের আলাপনে’, যুগ্ম গ্রন্থনাঃ ‘কৃষ্ণনগর সহায়িকা ও একনজরে নদীয়া’ (সহ লেখক গৌতম ধনী ); ‘ভারতীয় রেলের দেড়শো বছরঃএকটি সফর’ (১৮৫৩-২০০২) (সহ লেখক বিশ্বজিত দাস)।