– সঞ্জিত দত্ত
এবার কৃষ্ণনগরে গ্রন্থাগার কক্ষে বা লাইব্রেরী রুমে ‘জগদ্ধাত্রী’ মা পূজিতা হচ্ছেন। সরস্বতীর বদলে জগদ্ধাত্রী! চমকে যাওয়ার মত ব্যাপার। দেখা গেল কড়ি বরগার ছাদের নিচে থাকে থাকে বই সাজানো কাঠের আলমারি বা স্টিলের খোলা মঞ্চে। আছে মনীষীদের মূর্তি। দ্বিজেন্দ্রলাল, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ সহ আরো অনেকে।
জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই মনে আসে কৃষ্ণনগর আর চন্দননগরের কথা। যেন ‘এ টেল অব টু সিটিস’। চন্দননগর যদি ‘লাইটে হাইলাইটেড’ হয় তবে ‘জগদ্ধাত্রীনগর’ কৃষ্ণনগর দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীনত্ব. ঐতিহ্য, পরম্পরা আর সাজশিল্পের মহিমায় নান্দনিক সৌন্দয্যে ‘ঢল ঢল আভা লাবণ্য যোজনায় রঙের টেক্কা’। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হাত ধরে ১৭৫২ থেকে ১৭৫৬ সালের মধ্যে শুরু হওয়া বর্তমানকালের জগদ্ধাত্রী পুজো রাজবাড়ির নাটমন্দির থেকে রাজপথে, অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে।
আজকে চারিদিকে এত যে ‘থিম’এর চর্চা, তার জোয়ার লেগেছে‘জগদ্ধাত্রীনগর’কৃষ্ণনগরে
এখানেই ব্যাতিক্রম বাগদিপাড়া বারোয়ারীর এবারের জগদ্ধাত্রী পুজো। তাঁরা এবারের মণ্ডপসজ্জার বিষয় ভাবনায় তুলে এনেছেন ‘গ্রন্থাগার’। সারা রাজ্যে যখন কর্মীর অভাবে গ্রন্থাগারগুলি ধুঁকছে, পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে তখন গ্রন্থাগারের চিরকালীন অবদানের কথা মনে রেখে এবং মনে করিয়ে দিয়ে মানুষকে গ্রন্থাগারমুখি করার জন্যই তাঁদের এই থিম বা বিষয় ভাবনা।
মণ্ডপে প্রবেশ করলেই মনে হবে একটি সমৃদ্ধ ‘গ্রন্থাগার’এ এসে পড়েছি। থার্মোকল কেটে তার উপর বইয়ের রঙিন প্রচ্ছদ সেঁটে এত নিখুঁতভাবে গ্রন্থাগারের সম্পদ পুস্তকগুলিকে তৈরি করা হয়েছে যে দর্শকরা বিস্মিত হচ্ছেন। আসল নকল ধরা মুস্কিল। মনে হচ্ছে কোন বাড়ি বা দোকান কিংবা লাইব্রেরী থেকে বই তুলে এনে সাজানো হয়েছে। কাঠের আলমারিগুলিও ধরার উপায় নেই যে সেগুলি কৃত্রিমভাবে তৈরি। মণীষীদের মূর্তি গুলি প্লাস্টার অব প্যারিসে বানানো, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় জীবন্ত। সম্পূর্ণ গ্রন্থাগার জুড়ে বই পড়ার, গ্রন্থাগারে আসার আহ্বান। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের পাঁচটি সূত্র পাঠক পাঠিকাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। গ্রন্থাগার কক্ষের রূপ দেওয়া এই মণ্ডপে প্রবেশ করলে মনে হবে শুধু বিনোদন নয় ভক্তির সঙ্গে পড়াশুনার দরকার। অসংখ্য অভিনন্দন পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সমগ্র পরিকল্পনা ও বাস্তব রূপায়ন করেছেন পাড়ার ছেলে পেশায় শিক্ষক শিল্পী গৌতম বাগ।
গৌতম তথা বাগদীপাড়া বারোয়ারী কমিটির সদস্যদের উদ্দেশ্য বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনা। গৌতমের কথায়, “বর্তমানে ডিজিটাল দুনিয়ায় বইও হাতের তালুতে বন্দি। ভার্চুয়াল অস্তিত্ব। আজকের প্রজন্মের অনেক শিশুরা জানেও না লাইব্রেরী কি বস্তু। অনেক বাবা মা’র ব্যস্ততার কারণে শিশু কিশোরদের কাছে লাইব্রেরী এখনও অধরা। তাই আমরা চেয়েছি এই অপরিহার্য আনন্দের মাঝে তাঁদেরকে লাইব্রেরীর প্রয়োজন বোঝাতে। বইমুখী করে তুলতে।”
বাগদী পাড়ার অভিনব উদ্যোগ সারা ফেলে দিয়েছে কৃষ্ণনগরের বুকে। আসলে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী চিরদিনই এক আবেগের নাম। সেই আবেগ থেকেই এই সৃষ্টি।
পুজোয় নিয়মবিধি নিষ্ঠাসহকারে পালনের পাশাপাশি স্থানীয় নিজস্ব কিছু লোকাচার যেমন জলসাধা, ধুনোপোড়ানো, নবমী করা, ঘটবিসর্জন ইত্যাদি রয়েছে। শতাধিক ঢাককে সঙ্গী করে বেহারার কাঁধে বাঁশের সাঙে বিশাল প্রতিমা নিয়ে ছুটন্ত শোভাযাত্রা বিশেষ আকর্ষণীয়। আবেগের আবেশে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো অনেককিছু। ফলে এসেছে পরিবর্তনও। অভিনবত্ব। ভাবনায়। সজ্জায়।
চলুন বাগদীপাড়া ছেড়ে নামি কৃষ্ণনগরের জনপদে। খুঁজি এই বনেদী শহরে ভাবনাতে আর কি পরিবর্তন এল।
রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী ঘোড়াদাবা বা পৌরাণিক সিংহের উপর আসীনা রক্তবস্ত্রা, বর্ম পরিহিতা যুদ্ধরতা মূর্তি নগরের কোন বারোয়ারীতে এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। বৃটিশ রাজত্বকালে ঘোড়ামুখো সিংহ হয়েছে আফ্রিকান লায়ন। রাঢ়বাংলার সংস্কৃতি প্রভাবিত জগদ্ধাত্রীর ‘দেবীমূর্তি’ বা ‘প্রাচীন বাংলা’ মুখের আদল সামান্য বদলে এল ‘দোভাষি বাংলা’মুখ।
দেশভাগের পর ওপার বাংলার মানুষের আগমনের পর বেড়ে গেল তাঁদের পছন্দের ‘পুতুলমুখ’, স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা আনলেন অজন্তা ইলোরা অনুসরণে ‘আর্টের মূর্তি’। অনেকক্ষেত্রে আর্টের মূর্তিতে অবশ্য ঘোড়াদাবা সিংহকে রাখা হয়। যে আঙ্গিকেই গড়া হোক উৎকর্ষতায় অনবদ্য। পুরানো বারোয়ারীগূলো শতাধিক ঢাককে সঙ্গী করে বেহারার কাঁধে ভরসা রাখলেও বেড়ে যাওয়া পুজোর সংখ্যাকে সামাল দিতে একদিনের স্থানে দুদিন বিসর্জন দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয় দিনে প্রথাগত ঢাক থাকলেও ব্যান্ডপার্টি, ব্যাঞ্জোর সঙ্গে মহরমের লাঠিখেলার বাজনা তাসা ডগর মিলেমিশে একাকার হয়ে কার্নিভ্যালের রূপ নেয়। আগে ছিল খেউড়, সঙ-এর গান, ১৯৯৫ সাল থেকে এলো ঘট বিসর্জনে রঙিন ট্যাবলো। সমাজের অবিচার, বিকৃত মানসিকতা, কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব সঙ-এর গান আজকে ট্যাবলোয় ফুটে উঠে।
তবে ইদানিংকালে কিন্তু অন্য কোন পুজোর মত ‘থিম’এর সাথে সংগতি রেখে প্রতিমায় পরিবর্তন আনার আগ্রহ কম। সেখানে প্রতিমায় আদল, ছটা শুধু একই রাখা যেন একটা অলিখিত ট্রেডমার্ক তৈরি হয়ে গেছে। বাগদীপাড়া ‘থিমে’ অভিনবত্ব আনলেও দেবী প্রতিমার গরণে কিন্তু আটপৌড়ে ঐতিহ্যকেই ধরে রেখেছে।
লেখক পরিচিতি: সঞ্জিত দত্ত প্রাক্তন গ্রন্থাগারকর্মী।নিবাস কৃষ্ণনগর , নদীয়া । সংবাদ সাপ্তাহিক “গ্রাম গ্রামান্তর” পত্রিকার ২৫ বছর অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন । সম্পাদনা করেছেন ‘তীরন্দাজ নাট্যপত্র’, ‘রঙ বেরঙের আড্ডা’। নিত্য রেল যাত্রী হিসাবে রেল চর্চা সঞ্জিত বাবুর প্রিয় বিষয়। লিখেছেন “সংবাদ প্রতিদিন”, “কালান্তর”, “এশিয়ান এজ” দৈনিকে ও newsfromnadia.in । নদীয়া তথা স্থানীয় ইতিহাস চর্চার কাজে নিয়োজিত । প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘মায়াপুরঃ অতীত ও বর্তমান’ , ‘অঞ্জনা নদী তীরে ‘, ‘ফুলডোরে বাঁধা নদীয়া ও রবীন্দ্রনাথ’ | সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘সেতার’, ‘অ-শোক জীবন তিন ভুবন’, ‘কবিতার অলিন্দে জীবনের আলাপনে’, যুগ্ম গ্রন্থনাঃ ‘কৃষ্ণনগর সহায়িকা ও একনজরে নদীয়া’ (সহ লেখক গৌতম ধনী ); ‘ভারতীয় রেলের দেড়শো বছরঃএকটি সফর’ (১৮৫৩-২০০২) (সহ লেখক বিশ্বজিত দাস)।