সঞ্জিত দত্ত
২৯ জুলাই ‘বিশ্ব বাঘ দিবস (World Tiger Day)। নেট দুনিয়ার দৌলতে এবিষয়ে অনেকেই আজ কমবেশী অবগত আছেন। লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী ‘ব্যাঘ্র’ সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০১০ সালে সেন্ট পিটারসবাগ সম্মেলনের প্রস্তাব মেনে সারা বিশ্বে দিবসটি পালন করা হয়। একসময় রাজা মহারাজাদের শখের শিকার এবং পরবর্তী যুগে চোরাশিকারীদের চোরা শিকারের ফলে বাঘ কমে আসছিল বলেই এই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে মানুষখেকো বাঘদের মারতে হয়েছে। কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ (১৮৬২-১৯১১), জিম করবেট (১৮৭৫-১৯৫৫), গঙ্গা সিং (১৮৮০-১৯৪৩), গঙ্গা পুত্র সাদুল সিং (১৯০২-১৯৫০), কর্নেল শের সিং (১৯০৪-১৯৯৭), বুদ্ধদেব গুহ (জন্ম ১৯৩৬) প্রমুখ বহু বিখ্যাত শিকারী শখের শিকার নয়, সাধারণ মানুষ ও তাঁদের গৃহপালিত পশুদের জীবনরক্ষার জন্য মানুষখেকো বাঘ হত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
স্বাধীন ভারতে নদীয়ার শেষ স্বীকৃত মহারাজা ছিলেন মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায় বাহাদুর (রাজত্বকাল ১৯২৮-১৯৫৫)। মহারাজা ক্ষৌণীশচন্দ্র রায় বাহাদুর (১৮৯০-১৯২৮)এর পুত্র মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায় বাহাদুর পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন। দেশবিভাগের সময় নদীয়ার ভারতভুক্তি নিয়ে তাঁর মাতা মহারাণী জ্যোতির্ময়ী দেবী ও মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায় নিজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতে ১৯৬৯ সালে রাজন্যভাতা বিলোপের আগে অব্দি দুজনেই রাজন্যভাতা পেতেন। পিতার মতই সাহিত্যপ্রেমী এবং সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায়ের সুনাম ছিল। তিনিও ছিলেন একজন প্রথিতযশা শিকারী। ভারত সরকারের তরফ থেকে তাঁর ডাক পড়তো মানুষখেকো নিধনে একাজে তিনি সফলও।
১৯৫৮ সাল। সেন্ট্রাল প্রভিন্স (মধ্যপ্রদেশ/ছত্রিশগড়) থেকে খবর এলো মানুষখেকো রয়াল বেঙ্গল টাইগার প্রচণ্ড উৎপাত শুরু করেছে। তৎকালীন সেন্ট্রাল প্রভিন্সে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও প্যান্থার, ভাল্লুক সহ অন্যান্য হিংস্র বন্যপ্রাণী প্রচুর পরিমাণে ছিল। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস মুরগী ধরে নিয়ে যেত । কিন্তু যখন কোন বাঘ মানুষখেকো হয়ে উঠতো তখনই আতঙ্কগ্রস্থ মানুষকে রক্ষা করতে শিকারীদের ডাক পড়তো। সেন্ট্রাল প্রভিন্সের সরকারের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায় বাহাদুরকে অনুরোধ জানালেন ‘তাঁর রাজ্যে নরখাদককে নিধন মানুষকে বাঁচান’। সে ডাকে সারা দিয়ে শিকারী মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায় বাহাদুর এলেন মধ্যভারতের ব্যাঘ্র উপদ্রুত অঞ্চলে।
বাঘের পরিক্রমণ এলাকাও ছিল কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। একটি গ্রামে মানুষ মেরে চলে যেত অন্য কোন গ্রামাঞ্চলে। এখানকার গ্রামীণ জনপদে একটি গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের দূরত্ব ছিল বেশ কিছুটা। গ্রামবাসীদের মুখে পাওয়া বাঘের সংবাদের উপর ভিত্তি করে চলতে থাকলো অনুসন্ধান। একপক্ষ কাল পেড়িয়ে গেল বাঘের দেখা মিললো না। তিনি ফিরে আসবেন বলে ঠিক করলেন। এমন সময় ফিরে আসার আগেরদিন রাতে আবার একটি মানুষখেকোর সংবাদ পেলেন। একটি গ্রামে বাঘের হানায় মানুষ মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিলেন।অভিযানে সাথী হলেন ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটসহ কিছু অফিসার। বেশ কিছুটা খোঁজাখুঁজির পর একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হদিশ পাওয়া গেল। শিকারী তাঁর কর্তব্য কাজ করলেন। বাঘটি গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো। কাছে গিয়ে নিহত বাঘটিকে দেখে মহারাজা বিষণ্ণ হলেন। বাঘটি ছিল একটি মা বাঘ। কিছুটা দূরে ঝোপের নিরাপদ আশ্রয়ে তার দুটি শিশু শাবক রয়েছে। শিকারী মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায় বাহাদুর কোন গর্ভবতী বাঘ বা সদ্য মা হওয়া বাঘিনীকে শিকার করা পছন্দ করতেন না। শিশু ব্যাঘ্র শাবক দুটিকে দেখে তাঁর খুব মায়া হল। তিনি তাদের বাঁচাতে কোলে তুলে নিয়ে এলেন। তিনি বুঝলেন এটি মানুষখেকো বাঘ নয়। যদিও গ্রামবাসীদের ভুলসংবাদের জেরে এমন ঘটনা ঘটেছে তবু স্থির করলেন নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ব করতে এদের ‘দত্তক’ নেবেন। এদের তিনি সঙ্গে করে কলকাতার বাড়িতে নিয়ে যাবেন।পরদিন যখন রওনা দেওয়ার কথা ভাবছেন এমন সময় আবার খবর এলো পাশের অন্য একটি গ্রামে আবার বাঘের হানায় মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গ্রামবাসীদের মুখে সংবাদ পেয়ে ছুটলেন সেদিক। মিলল একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সন্ধান। বাঘটি তার শিকার করা গ্রামবাসীর মৃতদেহের কাছেই অবস্থান করছিল। বুঝা গেল এটিই আসল ম্যান-ইটার বা খুনি বাঘ। ইতিমধ্যে সে নয়টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। শিকারী মহারাজা তার ভবলীলা সাঙ্গ করে গ্রামবাসীদের মনের ভীতি দূর করলেন। খুশীর পরিমণ্ডলে গ্রামবাসীরা মহারাজাকে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন।
মহারাজা সৌরীশচন্দ্র রায় বাহাদুর এবার তাঁর পরিকল্পনা মত শিশু ব্যাঘ্র শাবক দুটিকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। বালিগঞ্জ এলাকার ২নং ব্রাইট স্ট্রিটের ‘দি ন্যুদিয়া হাউস’-এ নিজের রাজবাড়িতে তুললেন। ছেলে ব্যাঘ্র শাবকের নাম দিলেন ‘সামসন’ (Samson) আর মেয়েটির নাম ‘ডেলিলা’ (Delilah)। জঙ্গল ছেড়ে কংক্রিটের জঙ্গলে এসে মানুষের ভালবাসার সংস্পর্শে তারা পোষা কুকুরের মতই বড় হতে লাগলো। বাঘ দুটি রাজপ্রাসাদে ছাড়া থাকতো। স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতো। তাদের স্বভাবের এই অবিশ্বাস্য পরিবর্তন সত্বেও বাইরের মানুষ সহসা রাজপ্রাসাদের ত্রিসীমানায় পা দিতে ভয় পেতেন ।বাড়িতে অতিথি এলে তখন আগে থেকে তাদের অন্য ঘরে সরিয়ে দেওয়া হত। এদের দুটি বাচ্চাও হয়েছিল। ১৯৭২ সালে সরকার ‘বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করলেরাজবাড়িতে এভাবে বাঘ রাখা বে-আইনি হয়ে যায়। তখন বাধ্য হয়ে চিড়িয়াখানায় তাদের স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু ততদিনে স্থানীয় লোকের মুখে মুখে ‘দি ন্যুদীয়া হাউস’-এর নাম ‘বাঘবাড়ি’ হয়ে গেছে। এখন বাঘ নেই, একদিন হয়তো লোকায়ত নাম ‘বাঘবাড়ি’ও ভুলে যাবেন অনেকেই। থেকে যাবে ‘দি ন্যুদিয়া হাউস’ নাম, আর প্রবেশ পথে সাদা চুনে ঢাকা ‘মহারাজা বাহাদুর অফ ন্যুদীয়া’ লেখাটা।
তথ্য কৃতজ্ঞতা :নদীয়া রাজ পরিবারের শ্রীমণীশচন্দ্র রায়।