ববি, সুব্রতদের বিরুদ্ধে চার্জশিট: রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত বৈধ না অবৈধ?

– সুমন রায়।

গত ১৭মে সাত সকালে নারদা মামলায় আচমকাই গ্রেপ্তার হলেন রাজ্যের শাসক দলের দু’জন মন্ত্রী, একজন বিধায়ক এবং একজন প্রাক্তন মন্ত্রী৷ এই নিয়ে এখন সরগরম রাজ্য রাজনীতি৷ অভিযুক্তরা এখনও হেফাজতেই আছেন এবং তাদের জামিনের জন্য দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছেন দেশের প্রথম সারির আইনজীবিরা৷ সিবিআই এর হয়ে আদালতে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং দেশের সলিসিটর জেনারেল৷

এই মুহুর্তে একটি বিষয় নিয়ে জনমানসে ধোঁয়াসা তৈরী হয়েছে। বিধায়ক-সাংসদ-রাজ্যের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনও মোকদ্দমায় চার্জশিট দিতে গেলে বা তাদের গ্রেপ্তার করতে হলে বিধানসভা বা লোকসভার স্পীকার (বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের) অথবা রাজ্যপালের পূর্ব অনুমোদন (Prosecution Sanction) প্রয়োজন কিনা৷ অভিযুক্ত পক্ষের অন্যতম আইনজীবি ডঃ অভিষেক মনু সিংভি রাজ্যপালের এই অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন৷ আবার বিধানসভার মাননীয় স্পীকার বলেছেন, এক্ষেত্রে সিবিআই তাঁর কাছে কোনওরকম অনুমতি/অনুমোদন চায়নি৷

অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে আমরা বিষয়টির আইনগত বৈধতার দিকটি এক ঝলক দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব৷

সাধারণভাবে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৯৭ ধারাতে বলা আছে যে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব অনুমোদন ব্যাতীত কোনও আদালত কোনও জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, অথবা জনসেবকের (পাবলিক সার্ভেন্ট) বিরুদ্ধে  তাদের কর্তব্য পালন সম্পর্কিত কোনও অভিযোগ বিচারার্থে গ্রহন করবেন না৷ অর্থাৎ এঁদেরকে আদালতে অভিযুক্ত করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি বাধ্যতামূলক৷

এখন প্রশ্ন হল এই “জনসেবক” বা পাবলিক সার্ভেন্ট কারা। ভারতীয় দন্ডবিধির ২১ ধারাতে জনসেবকদের একটি তালিকা দেওয়া আছে, যারা এই তালিকাভূক্ত আছেন,তারাই জনসেবক৷ ১৯৪৭ সালের দূর্নীতি নিবারন আইনেও (Prevention of corruption Act, 1947) অনুরুপ একটি জনসেবকের তালিকা দেওয়া ছিল৷ মজার কথা হল, এই দুটি আইনেই মন্ত্রী বা সাংসদ-বিধায়কগণ “জনসেবক” তালিকাভূক্ত ছিলেন না৷ পরবর্তীকালে করুনানিধি বনাম ভারত সরকার মোকদ্দমায় (AIR1979SC 598) মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, যেহেতু মন্ত্রীরা সরকারী কোষাগার থেকে বেতন পান এবং জনস্বার্থে কাজ করেন, সেহেতু তারাও “জনসেবক” বলে বিবেচিত হবেন৷

এরপর  আর.এস. নায়ক বনাম এ.আর. আন্তুলে মোকদ্দমায়  (AIR 1984 SC 684) সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ভারতীয় দন্ডবিধি (Indian Penal Code) এবং তৎকালে বলবৎ থাকা দূর্নীতি নিবারন আইনের বিস্তারিত বিশ্লেষন করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বিধায়করা জনসেবকের অন্তর্ভূক্ত নন, যেহেতু তারা সরকারের শাসন বিভাগ থেকে কোনও বেতন পান না, তাঁরা সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করেন মাত্র৷ ঘটনাচক্রে এই মোকদ্দমাতেও সুপ্রীম কোর্টে সওয়াল করেছিলেন ডঃ অভিষেক মনু সিংভি ৷

পরবর্তীকালে ১৯৮৮ সালের ৯ সেপ্টেমবর  ১৯৪৭ সালের পুরনো দূর্নীতি নিবারন আইন রদ করে নতুন দূর্নীতি নিবারন আইন প্রবর্তন করা হয় (Prevention of Corruption Act,1988) এবং এই আইনে  ২(গ)৮ ধারা যোগ করে বলা হয় যে, কোনও ব্যাক্তি যার কোনও নির্দিষ্ট কার্যালয় আছে এবং যিনি সেই কার্যালয়ের বলে জনকর্তব্য সম্পাদন করতে হকদার অথবা বাধ্য, তিনিও “জনসেবক” বলে বিবেচিত হবেন৷ এই উপধারার ব্যাখ্যা করে এল.কে. আদবানী বনাম সি.বি.আই. মোকদ্দমায় দিল্লি হাইকোর্ট, হাবিবুল্লা খান বনাম উড়িষ্যা রাজ্য সরকার মোকদ্দমায় উড়িষ্যা হাইকোর্ট এবং নরসিমহা রাও এর মোকদ্দমায় সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বিধায়ক-সাংসদ দের “জনসেবক” হিসাবে গণ্য করা হবে৷

“চারজনই ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়োগ এবং পদচ্যুতি ঘটাতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হলেন রাজ্যপাল৷ অর্থাৎ যেহেতু ঘটনার সময় অভিযুক্তরা মন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু রাজ্যপাল প্রাক্তন মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এই পূর্বানুমতি দিয়েছেন। … রাজ্যপালের এই পূর্বানুমতি (prosecution sanction) উচিত বা অনুচিত যাই হোক না, সংবিধান অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত রীতিমত বৈধ এবং “রাজ্যপালের অনুমতি দেওয়া উচিৎ হয়নি” এই বলে কোনো মামলাও করা যাবে না৷”সুমন রায় (আইনজীবি)

এই নতুন আইনের ১৩ ধারার বিভিন্ন উপধারাতে বলা হল, যদি কোন জনসেবক বা পাবলিক সার্ভেন্ট অভ্যাসবশতঃ কূ-উদ্দেশ্যে কোনও ব্যাক্তির কাছ থেকে আইন সঙ্গত বেতন ব্যাতিরেকে কোনরকমের উৎকোচ গ্রহন করেন, তাহলে বলা হবে যে তিনি “অপরাধজনক অসদাচরণ” (criminal misconduct) সংগঠন করেছেন৷ বর্তমানে হেফাজতে থাকা হেভিওয়েট নেতাদের বিরুদ্ধে ঠিক এই অভিযোগই আনা হয়েছে, যা প্রমানিত হলে তাদের কারাবাস পর্যন্ত হতে পারে৷ কিন্তু এই ১৩ ধারাতে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে “দোষারোপ পত্র” (charge sheet) পেশ করতে হলে এই আইনের ১৯ ধারা মতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি প্রয়োজন, নচেৎ মোকদ্দমাটিকে আদালত বিচারার্থে গ্রহন করবেন না৷

এখন প্রশ্ন হল জনসেবকদের বিরুদ্ধে দূর্নীতি নিবারন আইনে চার্জশিট দিতে হলে তার আগাম অনুমতি কে দেবেন? প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা থাক, এই পূর্বানুমতি প্রয়োজন কিন্তু শুধুমাত্র চার্জশিট দাখিল করার জন্য। কিন্তু তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য কোনও কর্তৃপক্ষের কোনও আগাম অনুমতির কোনও প্রয়োজন নেই৷

মে ১৭, ২০২১ তারিখে আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চলতি তার আগের দিন অর্থাৎ মে ১৬ তারিখে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যর্থতার অভিযোগ  তুলে শিলিগুড়ির রাস্তায় ধর্নায় বসেন তিন বিজেপি  বিধায়ক (শঙ্কর ঘোষ, শিখা চট্টোপাধ্যায়, আনন্দময় বর্মণ)৷ তৎক্ষণাৎ তাদের গ্রেপ্তার করা হয়৷ কোনও পূর্বানুমতির প্রয়োজনও ছিল না। প্রশ্নও ওঠেনি৷

যাইহোক, ১৯৮৮ সালের দূর্নীতি নিবারন আইনের ১৯(১)(এ) ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যাক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বিষয়ে কর্মরত আছেন এবং যাকে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন ছাড়া পদচ্যুত করা যায় না, তাঁর ক্ষেত্রে এই পূর্বানুমতি দেবেন কেন্দ্রীয় সরকার৷ অনুরুপভাবে ১৯(১)(বি) ধারাতে বলা হয়েছে, যে ব্যাক্তি রাজ্য সরকারের কোনও বিভাগে কর্মরত আছেন এবং যাকে রাজ্য সরকারের অনুমোদন ছাড়া পদচ্যুত করা যায় না, তাঁর ক্ষেত্রে এই পূর্বানুমতি দেবেন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার৷

কিন্তু সাংসদ বা বিধায়কগণ এই দুটি ক্ষেত্রের কোনওটির মধ্যেই পড়েন না৷ তাহলে তাদের ক্ষেত্রে এই পূর্বানুমতি প্রদান করবেন কে? এই আইনের ১৯(১) (সি) ধারাতে বলা আছে, উপরে বলা দুটি ক্ষেত্র ছাড়া অন্য যে কোনও ব্যাক্তির ক্ষেত্রে এই পূর্বানুমতি প্রদান করবেন সেই কর্তৃপক্ষ যিনি ঐ ব্যাক্তিকে পদচ্যুত করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা হকদার৷ বিধায়কদের পদচ্যুত করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হলেন বিধানসভার স্পীকার এবং সাংসদদের ক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হলেন লোকসভার স্পীকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান৷ অর্থাৎ সাংসদ বা বিধায়কদের ক্ষেত্রে দূর্নীতি নিবারন আইনে চার্জশিট দিতে হলে আগাম অনুমতি নিতে হবে (রাজ্যসভার চেয়ারম্যান) লোকসভা বা বিধানসভার স্পীকারের কাছ থেকে৷

এখন প্রশ্ন হল, তাহলে রাজ্যপাল এই পূর্বানুমতি দিলেন কি করে? এর সহজ উত্তর হল,ঘটনার সময় ধৃত এই চারজনই ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়োগ এবং পদচ্যুতি ঘটাতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হলেন রাজ্যপাল৷ অর্থাৎ যেহেতু ঘটনার সময় অভিযুক্তরা মন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু রাজ্যপাল প্রাক্তন মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এই পূর্বানুমতি দিয়েছেন। প্রাক্তন বা বর্তমান বিধায়কদের বিরুদ্ধে এই পূর্বানুমতি দেন নি৷

এবারে শেষ প্রশ্ন। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচিত শাসকই প্রকৃত শাসক এবং এখানে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের ভূমিকা নিছক নিয়মতান্ত্রিক শাসকের৷ সাধারণভাবে নিয়মতান্ত্রিক শাসক নির্বাচিত শাসকের পরামর্শ এবং সাহায্যেই শাসনকার্য পরিচালনা করবেন এমনটাই কাম্য৷ কিন্তু ভারতীয় সংবিধনের ১৬৩(১) ধারা রাজ্যপালকে কিছু বিষয়ে “স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা”(discretionary power) প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে এবং ১৬৩(২) ধারা পরিস্কারভাবে বলেছে যে কোন্ বিষয়ে রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা কতদূর বিস্তৃত হবে – এ বিষয়ে রাজ্যপালের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত এবং “তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করা উচিৎ হয়নি” বলে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না৷ ১৬৩(৩)ধারা আরও বলছে, এই বিষয়ে মন্ত্রীসভা রাজ্যপালকে কোনও পরামর্শ দিয়েছিল কিনা, সে নিয়েও কোনও আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না৷ অতএব, রাজ্যপালের এই পূর্বানুমতির (prosecution sanction) উচিত বা অনুচিত যাই হোক না, সংবিধান অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত রীতিমত বৈধ এবং “রাজ্যপালের অনুমতি দেওয়া উচিৎ হয়নি” এই বলে কোনো মামলাও করা যাবে না৷

এখন কথা হল, রাজ্যপালের এই পূর্বানুমতি কি বেনজির? আগে কোনও রাজ্যপাল কি এমন পূর্বানুমতি দিয়েছেন মন্ত্রীসভাকে পাশ কাটিয়ে? তাদের পরামর্শ ছাড়া স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাকে প্রয়োগ করেছেন? উত্তর হল – হ্যাঁ৷ এর আগেও এমন একাধিক নজির আছে৷

অতীতে লালু প্রসাদ যাদবের ক্ষেত্রে বিহারের রাজ্যপাল, জয়ললিতার ক্ষেত্রে তামিলনাডুর রাজ্যপাল এমন পূর্বানুমতি প্রদান করেছেন৷ দুটি ক্ষেত্রেই পাটনা হাইকোর্ট (জুন ২১, ২০০৫; তিন সদস্যের বেঞ্চ) এবং মাদ্রাজ হাইকোর্ট (অক্টোবর ১, ১৯৯৭) এই পূর্বানুমতিকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছেন৷ তারও আগে জুলাই ২৮,১৯৮২ তারিখে রামদাস শ্রীনিবাস বনাম মহারাষ্ট্র সরকার মামলাতে সুপ্রীম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বম্বে হাইকোর্টের রায়কে সমর্থন করে রায় দেন যে,  “(এই)পূর্বানুমতির প্রশ্নটি রাজ্যপালের ব্যাক্তিগত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমেই স্থিরীকৃত হওয়ার যোগ্য এবং রাজ্যপালের সিদ্ধান্তই এ বিষয়ে চুড়ান্ত৷” ২০০৪ সালে মধ্যপ্রদেশ স্পেশাল পুলিশ এসটাবলিশমেন্ট বনাম মধ্য প্রদেশ সরকার মোকদ্দমায় বিচারপতি হেগড়ের নেতৃত্বাধীন সুপ্রীম  কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চও রাজ্যপালের এই ক্ষমতাপ্রয়োগকে বৈধতা দিয়েছেন৷ এখানে একটি কথা উঠতে পারে যে রাজ্যপাল এই অনুমোদন দেওয়ার আগে মন্ত্রীসভার সাথে পরামর্শ করলেন না কেন? কারন যাইই থাক, আমরা আইনগত ভাবে এটুকু অন্তত বলতে পারি যে, এক্ষেত্রে মন্ত্রীসভার পরামর্শ চাওয়ার কোনও আইনানুগ বাধ্যবাধকতা রাজ্যপালের ছিল না৷

পরিশেষে বলি, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন৷ আমরা বিষয়টিকে একটি সাধারণ আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলাম৷ বিষয়টির চুড়ান্ত নিস্পত্তি আদালতেই হবে৷


লেখক পরিচিতি:
লেখক সুমন রায় গত প্রায় দুই দশক যাবৎ পেশাদারী আইনজীবি হিসাবে কর্মরত। এই নিবন্ধে প্রকাশিত বক্তব্য তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত।

Share the news