সঞ্জিত দত্ত
আগস্ট ২ ,২০২২: পশ্চিমবঙ্গে আরও সাতটি নতুন জেলা গড়ার ঘোষণা হলো। রাজ্যের এখনকার ২৩টি জেলার মধ্যে নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪পরগণা, দক্ষিণ ২৪পরগণা এবং বাঁকুড়া জেলাকে ভেঙে নতুন এই সাতটি জেলা সৃষ্টি করা হচ্ছে। নতুন জেলাগুলি হবে নদীয়ায় রাণাঘাট, মুর্শিদাবাদে জঙ্গিপুর ও কান্দি, উত্তর ২৪পরগণায় বনগাঁ এবং বাগদা নিয়ে ইছামতী ও বসিরহাট, দক্ষিণ ২৪পরগণায় সুন্দরবন, বাঁকুড়ায় বিষ্ণুপুর। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়িত হবে। ১আগস্ট ২০২২ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘোষণা করার পর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রতিবাদ হচ্ছে। আবার পাশাপাশি রাণাঘাটে শাসকদলের সমর্থকদের মুখ্যমন্ত্রীর ছবিতে মুখমিষ্টি করাতে দেখা গেছে।
নদীয়া জেলার ক্ষেত্রে ‘নদীয়া’ নামটি মুছে দিয়ে প্রস্তাবিত জেলা দুটির নামকরণ ‘কৃষ্ণনগর’ ও ‘রাণাঘাট’ জেলার করায় জেলার মানুষের প্রবল আপত্তি। ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে কৃষ্ণনগর এবং রাণাঘাট নামে দুটি ‘পুলিশ জেলা’ তৈরি করা হয়েছে। সেই পুলিশ জেলাকে এবার প্রশাসনিক জেলার রূপ দেওয়া হচ্ছে। জেলা বিভাজন নিয়ে জনমতেরও বিভাজন দেখা যাচ্ছে। একদল প্রশাসনিক সুবিধার কারণে জেলা ভাগ মেনে নিলেও নাম পরিববর্তনে প্রবল আপত্তি জানাচ্ছেন। একই চিত্র মুর্শিদাবাদ জেলার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। সেখানে ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুর্শিদাবাদ জেলার নামের অবলুপ্তি মেনে নিতে পারছেন না।
নদীয়া জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধের পর বৃটিশরা ক্ষমতা পেয়ে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং ১৭৭২ সালে রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার্থে একজন ইংরেজ কালেক্টরের অধীনে ‘নদীয়া’কে সারা বাংলা তথা ভারতের মধ্যে প্রথম কালেক্টরেট জেলা হিসাবে ঘোষণা করেন। কিন্তু নদীয়া নামটি প্রায় হাজার বছর ধরে প্রচলিত রয়েছে। নবদ্বীপ এবং নদীয়া নাম দু’টি পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নদী মাতৃক জেলা নদীয়ার নামকরণে নদীর অবদান রয়েছে। নবদ্বীপ > ন অ দ্দী অ > নদীঅ > নদীয়াহ > নদীয়া। ৭৫০ খৃষ্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট হিসাবে গোপাল পাল সাম্রাজ্যের পত্তন করলে নবদ্বীপ বা নদীয়া পাল সাম্রাজ্যের ভুক্তির (প্রদেশ) অন্তর্গত বিষয় (বিভাগ) ও মণ্ডলের(জেলা)অধীন ছিল। পাল সাম্রজ্যের পতনের পর সেন রাজবংশের রাজত্বকালে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে (বিজয় সেন, বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন) নবদ্বীপ বা নদীয়া তাঁদের অন্যতম রাজধানী তথা প্রশাসনিক ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ১১৯৪ খৃষ্টাব্দে (৫৯৯ হিজরি) বখতিয়ার উদ্দিন খলজি (Mahammad-i-Bakht-yar) নবদ্বীপ বা নোদীয়াহ/ন্যুদীয়াহ (City of Nudiah) বিজয় করেন। নদীয়া বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে মুগীস উদ্দীন য়ুজবক সুলতান-এর নামে (in the name of Sultan, Muizza-ud-Din, Mahammad-i-Sam) ১২৫৫ সালে (৬৫৩ হিজরি) একটি স্মারক রজত মুদ্রা নদীয়া টাঁকশাল (নূদীয়া খাজাঞ্চায় প্রস্তুত) থেকে প্রচলন করা হয়েছিল। ‘নদীয়ার চাঁদ’ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু’র (১৪৮৬ খৃ.– ১৫৩৩ খৃ.) সামাজিক ও ভক্তি আন্দোলনের সময় সমসাময়িক বৈষ্ণবসাহিত্য ও চৈতন্য জীবনীকারদের লেখায় বিভিন্নভাবে নদীয়া নামটি এসেছে। ১৬৬৬ সালে তাভেরনীয়রের লেখায় নদীয়া নামের অস্তিত্ব নজরে পড়ে।
বৃটিশ শাসনকালে প্রশাসনিক কারণে বিভিন্ন সময়ে নদীয়া জেলার অঙ্গহানি করে পার্শ্ববর্তী জেলা বা অঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।১৭৯৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বসিরহাট ও সংলগ্ন বেশ কিছুটা এলাকা নদীয়া থেকে যশোহরের সঙ্গে এবং আনারপুর মৌজা ২৪ পরগণার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। দু’বছর পর ১৭৯৫ সালে নদীয়ার অনেকস্থান বর্ধমান ও হুগলী জেলার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। পরের বছর ১৭৯৬ সালের ১৯ জানুয়ারী নদীয়ার অনেকটা অঞ্চল মুর্শিদাবাদে যুক্ত হয়। ১৮৩৪ সালে নদীয়ার কয়েকটি পরগণা নিয়ে বারাসতে জেলা গঠন করা হয়। একই ভাবে ১৮৮২ সালের ১লা জুন বনগ্রাম মহকুমাকে যশোহরের এবং ১৮৮৮ সালের ১লা এপ্রিল অগ্রদ্বীপকে বর্ধমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এরপর বড় বিভাজন ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙা মহকুমার সমগ্র অঞ্চল এবং করিমপুর ও তেহট্ট থানা এলাকা বাদে মেহেরপুর মহকুমার বৃহত্তর অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে নদীয়ার করিমপুর থানার টলটলি ও পরাশপুর মৌজা দু’টি মুর্শিদাবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের (Radcliffe) বিভাজন সূত্র ধরে নদীয়া জেলা বিভক্ত হওয়ার পর ১৫ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ বিভ্রান্তিকর তিনটি দিন অতিবাহিত করেছেন জেলাবাসী। তেমনই বিভাজিত জেলা নামকরণেও বিভ্রান্তি দেখা দেয়। নবগঠিত কুষ্টিয়া জেলার নাম নদীয়া রাখা হচ্ছে শুনে নদীয়া জেলার মূল ভুখন্ডের নাম ‘নবদ্বীপ’ জেলা এবং নবদ্বীপ থানার নাম ‘নদীয়া’ থানা রাখা হয়। কিন্তু যখন দেখা গেল কুষ্টিয়া নাম পরিবর্তন করা হলো না তখন হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জেলাবাসীর আবেগকে মাথায় রেখে ছয় মাস পরে ১৯৪৮ সালে আবার দুটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে পুনরায় নাম পরিবর্তন করে ‘নদীয়া’ জেলা এবং ‘নবদ্বীপ’ থানা নাম ফিরিয়ে আনা হয়।১৯৪৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘নবদ্বীপ’ জেলার নাম পরিবর্তন করে আবার ‘নদীয়া’ রাখা হয়,(নং545 G.A Dated 23.02.1948. u/s.7(2) of Cr.P.C.1898).এবং ‘নদীয়া’ থানার নাম বদলে আবার ‘নবদ্বীপ’ থানা রাখা হয় (নং 546 G.A Dated 23.02.1948. u/s.7(1) of Cr.P.C.1898).। ১৯৪৭ সালের আগে বৃটিশরা একাধিকবার নদীয়া জেলার অঙ্গহানি ঘটালেও ‘নদীয়া’ জেলার নাম পাল্টে দেয়নি।
জেলা ভাগ করে নতুন জেলা গঠন বিষয়ে ঘোষণা হতেই রাজনৈতিক তর্জা শুরু হয়েছে। ব্যঙ্গ বিদ্রূপও চলছে। সাধারণ মানুষ চাইছেন জেলার নামের সঙ্গে ‘নদীয়া’ শব্দটা যুক্ত থাক। প্রয়োজনে ‘নদীয়া উত্তর’, ‘নদীয়া দক্ষিণ’ করা হোক। স্বাধীনতা প্রাপ্তিকালে জেলার অঙ্গহানি হয়েছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর এবং বৃটিশদের হাতে নদীয়া জেলা গঠনের দু’শ বছরে আবার অঙ্গচ্ছেদ। তাঁদের অভিমত অন্তত ‘নদীয়া’ নামটা বেঁচে থাক।
লেখক পরিচিতি: সঞ্জিত দত্ত
প্রাক্তন গ্রন্থাগারকর্মী। নিবাস কৃষ্ণনগর , নদীয়া । সংবাদ সাপ্তাহিক “গ্রাম গ্রামান্তর” পত্রিকার ২৫ বছর অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন । সম্পাদনা করেছেন ‘তীরন্দাজ নাট্যপত্র’, ‘রঙ বেরঙের আড্ডা’। লিখেছেন “সংবাদ প্রতিদিন”, “কালান্তর”, “এশিয়ান এজ” দৈনিকে । নদীয়া তথা স্থানীয় ইতিহাস চর্চার কাজে নিয়োজিত । প্রকাশিত গ্রন্থ -‘মায়াপুরঃ অতীত ও বর্তমান’ , ‘অঞ্জনা নদী তীরে ‘, ‘ফুলডোরে বাঁধা নদীয়া ও রবীন্দ্রনাথ’ , সম্পাদিত গ্রন্থ ‘সেতার’, ‘অ-শোক জীবন তিন ভুবন’, ‘কবিতার অলিন্দে জীবনের আলাপনে’, যুগ্ম গ্রন্থনাঃ ‘কৃষ্ণনগর সহায়িকা ও একনজরে নদীয়া’ (সহ লেখক গৌতম ধনী ); ‘ভারতীয় রেলের দেড়শো বছরঃ একটি সফর’ (১৮৫৩-২০০২) (সহ লেখক বিশ্বজিত দাস)।