হৃদয়পুর-মুজিবনগর সড়ক যোগাযোগ: ভারত-বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের নতুন দিশা

ভারতের পেট্রাপোল আন্তর্জাতিক স্থল বাণিজ্য বন্দর থেকে বাংলাদেশের বেনাপোল স্থল বাণিজ্য বন্দরের ঢোকার প্রধান ফটক।।

সঞ্জিত দত্ত

২০২২ সাল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের জন্ম শতবর্ষ। আবার নদীয়া জেলা সৃষ্টির ২৫০ বছর। এই স্মরণীয় বছরে নদীয়াবাসী, শুধু নদীয়াবাসী কেন ভারত বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ একটি উপহার পেতে চলেছেন। প্রতিবেশী দুটি দেশের মানুষের নানা প্রয়োজনে যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু আছে। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চল দিয়ে তা পরিচালিত হয়।  এবার উপহার হিসাবে নদীয়া জেলার আর একটি বাড়তি এলাকা এই কাজের জন্য যুক্ত হচ্ছে।   

বর্তমানে উত্তরের হিলি কিংবা দক্ষিণের বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত অঞ্চলের সড়ক স্থল বন্দর দিয়ে  এবং গেদে দর্শনা রেলপথে ভারত বাংলদেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। মানুষ যাতায়াতের  কাজও এখান দিয়ে হয়ে থাকে।  এবার নদীয়ার হৃদয়পুর-মুজিবনগর সীমান্তে আরও  একটি যাত্রী গমনাগমনের কেন্দ্র ( Entry-Exit Point) এবং কৃষ্ণগঞ্জ থানার টুঙ্গিতে  একটি সড়ক  স্থল বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এব্যাপারে ভারত বাংলাদেশ উভয়দেশ সহমতে পৌঁছেছে। প্রশাসনিক স্তরে কাজও অনেকটা এগিয়ে গেছে।

১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে রাণাঘাট গেদে হয়ে দর্শনা পর্যন্ত প্রথম রেলপথ চালু হয়। দার্জিলিং মেল, আসাম মেল, পার্বতীপুর এক্সপ্রেসের মতো যাত্রীবাহী ট্রেন এই পথে চলতো। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে যায়।  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রেলপথে পণ্য পরিবহনের জন্য এই রেলপথ ব্যবহৃত হয়। ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ এই পথে চলে। অন্যদিকে টুঙ্গি এবং হৃদয়পুর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বৃটিশ আমল বা তারও থেকে সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। প্রায় শতবর্ষ আগে ১৯২৫ সালে নদীয়ায় প্রথম যাত্রীবাহী বাস চলাচল শুরু হয় কৃষ্ণনগর থেকে চাপড়া, হৃদয়পুর হয়ে মেহেরপুর পর্যন্ত। দত্ত কোম্পানির একটি লাল বাস সকালে কৃষ্ণনগর থেকে যেত এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসতো। বাসে যাত্রী টানার জন্য উপহার হিসাবে রুমাল, মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে প্রলুব্ধ করা হতো। চাপড়ায় বাসের ইঞ্জিন ঠান্ডা করার জন্য অনেকটা সময় দাঁড়াতে হতো এবং ইঞ্জিনে জল দেওয়া হতো। এই রুট বা পথকে কৃষ্ণনগর মেহেরপুর রোড বলা হতো। দেশভাগের পরে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ বসু এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদানের কথা স্মরণে রেখে মেহেরপুর রোডের নামকরণ করা হয় আজাদ হিন্দ সড়ক। পরে ১৯৪৯-৫০ সালে চাপড়া থেকে করিমপুর পর্যন্ত নতুন  সড়ক সংযোগ এবং ঘূর্ণী বাইপাস তৈরি হলে এই রাস্তার নাম হয় কৃষ্ণনগর করিমপুর রোড।  এখনও কৃষ্ণনগর পৌরসভা  ঘূর্ণী এলাকায়  আজাদ হিন্দ সড়ক নামটি রয়ে গেছে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল হৃদয়পুরের পূর্বদিকে বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ করে এবং বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর ।  বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরে এখন একটি দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের সময়ে কৃষ্ণনগর থেকে মুজিবনগর পথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে তাই চাপড়া থেকে হৃদয়পুর ,  মুজিবনগর হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রাস্তাটির নাম রাখা হচ্ছে ‘’স্বাধীনতা সড়ক’’। বাংলাদেশের দিকে  পরিকাঠামোর কাজ অনেকটাই সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। হৃদয়পুরে ছয়শো মিটার নতুন রাস্তা এবং পাসপোর্ট ভিসা  ইমিগ্রশন চেকিং পয়েন্টের নির্মাণ কাজ হয়ে গেলেই নদীয়া থেকে এখান দিয়ে ভারত বাংলাদেশ যাতায়াত শুরু হবে। অন্যদিকে টুঙ্গি দিয়ে  সড়ক স্থল বন্দর গড়ে তোলা হবে। কৃষ্ণগঞ্জের মাজদিয়া টুঙ্গি থেকে সীমান্ত পেরিয়ে জীবননগর কালীগঞ্জ হয়ে ঢাকা এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরে ঢাকা বা অন্যত্র খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।  এবছর জুন  মাসে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়ে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হয়ে যাবে।

১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে টুঙ্গি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে তৈরি অনেকগুলি দোতলা বা ডাবল ডেকার বাস  বাংলাদেশের   রাজধানীর  জনপরিবহনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মাজদিয়া স্টেশনের কাছে রেলের রোড আন্ডার পাস দিয়ে উঁচু গাড়ি চলাচলে সমস্যা রয়েছে। সেকারণে তখন দোতলা বাসগুলিকে কৃষ্ণনগর হাঁসখালি নোনাগঞ্জ হয়ে বিকল্প পথে টুঙ্গি আনা হয়েছিল। বর্তমানে কৃষ্ণনগর মাজদিয়া, কৃষ্ণনগর হাঁসখালি রাস্তা চওড়া এবং উন্নত  করার কাজ চলছে। পাশাপাশি ‘’ ভারতমালা প্রকল্প’’-এ সীমান্ত সড়কের উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৩৪ নং জাতীয় সড়কের বিকল্প পথ হিসাবে এই প্রকল্পে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকে লালগোলা, ভগবানগোলা, লালবাগ, ডোমকল, জলঙ্গী, করিমপুর, তেহট্ট,  চাপড়া, কৃষ্ণনগর, হাঁসখালি, বগুলা, বনগ্রাম, স্বরূপনগর, তেঁতুলিয়া, বসিরহাট পর্যন্ত ৩১৮ কি.মি. চার লেনের রাস্তা নির্মাণ করা হবে। নাম দেওয়া হবে ৩১২ নং জাতীয় সড়ক। পথিমধ্যে যেখানে রাজ্য সড়ক পড়বে সেগুলি ৯০ ফুট চওড়া করা হবে।

নদীয়া জেলার সার্ধ দ্বিশত বর্ষ পূর্তিতে নদীয়াবাসীরা  মনে করছেন এই সব প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত হলে নদীয়ার আর্থ সামাজিক অবস্থার একটা বড় পরিবর্তন ঘটবে। হিলি বা বেনাপোল পেট্রাপোলের উপর চাপ কমবে। পাশাপাশি নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে  হৃদয়পুর , টুঙ্গি ইমিগ্রশন চেকিং পয়েন্টে মানুষ ও পণ্যবাহী গাড়ির যাতায়াত সহজ হবে। ভ্রমণ পর্যটক বা চিকিৎসা পর্যটকদের এই পথে যাতায়াত বাড়বে। এই সম্ভবনার কথা মাথায় রেখে স্বনির্ভর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নদীয়ায় পর্যটন গাইড তৈরির জন্য শতাধিক যুবক যুবতীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।  তাঁরা নদীয়ার দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে ভ্রমণ পিপাসুদের পরিচয় ঘটাবেন।

রাস্তা সম্প্রসারণ কাজে অনেক জায়গায় দোকান বা বসতবাটি উচ্ছেদের সম্মুখীন হবে এটা ঠিক তবে চাপড়া, বড় আন্দুলিয়া, তেহট্ট, বেতাই, করিমপুরের মতো গঞ্জ এলাকার বাণিজ্যিক মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে নদীয়াবাসী মনে করছেন। তাই তাঁরা  নদীয়া জেলার সার্ধ দ্বিশত বর্ষ পূর্তিতে  নতুন উপহার প্রাপ্তির সংবাদে উচ্ছ্বসিত।

Share the news