চাকদহ: খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, চাকদহ শহরে রবিবারের সকালগুলো হয়ে উঠত সঙ্গীতময়। সুর পিপাসু চাকদহবাসীদের অনেকেই রবিবার সকালে দাম্পত্য অশান্তির সম্ভাবনা ষোলো আনা জিইয়ে রেখে থলে নিয়ে বাজারমুখী না হয়ে ‘টিকিট’ হাতে ছুটতেন ভারতী সিনেমা হলে প্রভাতী সঙ্গীত আসরে হাজির হতে। আশির দশকের শুরু থেকেই শহরের বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন ভারতী সিনেমা হল হয়ে উঠেছিল চাকদহে ধ্রুপদী সঙ্গীত প্রেমীদের তৃষ্ণা নিবারণের মূল স্থান। এবং তা ছিল মূলতঃ রবিবারের সকাল বেলা। কিছুদিন পর যেন তাল কাটল। হঠাৎই যেন বন্ধ হয়ে গেল ভারতী হল সহ প্রায় সব অনুষ্ঠান। সংগীত চর্চার রেশ না কাটলেও, ধ্রুপদী সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজনের খামতি দেখা দিল চাকদহ শহরে।
সুখের কথা, সেই খামতির অবসান হতে চলেছে। চাকদহের সুরের চাতকদের তৃষ্ণা মেটাতে এই শহরেরই জেনারেশন ওয়াই’এর অন্ততঃ কুড়িটি কচি কাঁচা দলবেঁধে এগিয়ে এসেছে। ওঁরা ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের কোন না কোন ধারার নিত্য সাধক। ওঁদেরই উদ্যোগে জুন মাসে ভূমিষ্ঠ হয়েছে “মীড়”। যাঁর প্রথম নিবেদন আগামী ২০ জুলাই সন্ধ্যায় চাকদহ শহরেরই সম্প্রীতি মঞ্চে। ঐদিন ওঁরা চাকদহের সঙ্গীত প্রেমীদের হারিযে যাওয়া জলসার স্মৃতি উস্কে দেবে। শহরের সুধীজনদের কন্ঠে, যন্ত্রে, ছন্দে, তালে মুগ্ধ করতে ওঁরা বদ্ধপরিকর।
চলুন “মীড়” এর অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে আশির দশকের ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো উল্টে দেখি। হপ্তান্তের শনি আর রবিবারের সন্ধ্যা আর সকালগুলোর রোমন্থন করি।
সত্যি কথা হল চাকদহের সঙ্গীতপ্রেমীরা এই ‘প্রভাতী সংগীতানুষ্ঠানের’ এক নতুন ধারার সূচনা করেছিল ভারতী হলের মাধ্যমে। সুরের টানে বাজার হাট ফেলে ভেতো বাঙ্গালী দাম্পত্য অশান্তি তৈরী করে যে সকল ন’টা তেও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ন করে দিতে পারে তার সাক্ষি ছিল রবিবারগুলো। সংগীতপ্রেমীদের চাপে হামেশাই পিছোত ভারতী সিনেমা হলের ম্যাটিনি শো। ন’টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে শেষ হতে দুপুর দুটোর কাঁটা ছুঁয়ে যেত। চাকদহে আজ যে সঙ্গীত চর্চার আধিক্য, অলিতে গলিতে গান, নাচ শেখানোর স্কুল দেখা যায়, সেই সব উদ্যোগের অনুপ্রেরণা আসলে যে আশির দশকের শনি আর রবিবারের ধ্রুপদী সঙ্গীতময় সকাল আর সন্ধ্যাগুলো ছিল তা আশাকরি অনেকেই মানবেন।
কিন্তু দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক ধরে চলার পর এই সংগীতানুষ্ঠানগুলির আয়োজন যেন হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। যে রবিবারগুলো কখনও শুরু হত অমর পালের প্রভাতী গানে বা আলি আহমেদ হুসেনের শানাইয়ে ললিত রাগের মূর্ছনায়, তা যেন হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেল।
নতুন শতকের শুরুর দিকে চাকদহ পুরসভার উদ্যোগে সংস্কৃতি চর্চার নতুন কেন্দ্র সম্প্রীতি মঞ্চ স্থাপিত হলেও ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠানের সেই ট্র্যাডিশন ফিরে এল কই।
চাকদহের সঙ্গীতপ্রেমীদের যাঁদের বয়স বর্তমানে অন্ততঃ চল্লিশ বা তাঁর বেশী তাঁদের স্মৃতিতে এখনও নিশ্চিত ভাবে যে নামগুলো রবিবারের সকাল বা শনিবারের সান্ধ্য স্মৃতিমেদুরতা তৈরী করে সেগুলো হল আলি আহমেদ হুসেন, শঙ্কর ঘোষ, তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, বিক্রম ঘোষ, রেজা আলী খাঁ, সাব্বির খাঁ, ধ্যানেশ খাঁ, রাজীব চক্রবর্তী, কুশল চক্রবর্তী, অজয় চক্রবর্তী, মানস চক্রবর্তী, হৈমন্তী শুক্লা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, আশিস খাঁ প্রমুখ। আর অন্যধারার বাংলাগানের শিল্পীদের কথা যদি স্মরণ করি তাহলে তালিকা দীর্ঘ হবে।
সমকালীন প্রেক্ষাপটে বাংলার হেন কোন শিল্পী নেই যিনি চাকদহের সঙ্গীত প্রেমীদের মনোরঞ্জন করেননি। বাবা পন্ডিত শঙ্কর ঘোষের হাত ধরে মঞ্চানুষ্ঠানে ক্ষুদে বিক্রম ঘোষের হাতেখড়ির স্বাক্ষী হওয়া থেকে থেকে শুরু করে চাকদহের সঙ্গীত প্রেমীরা সান্নিধ্য পেয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, শ্যামল মিত্র, ধীরেন বসু, বনশ্রী সেনগুপ্ত, নির্মলা মিশ্র, সুবীর সেন, শ্রীকান্ত আচার্য্য, সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা চক্রবর্তী, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতাশঙ্করের মত গুনী শিল্পীদের|
“যে রবিবারগুলো কখনও শুরু হত অমর পালের প্রভাতী গানে বা আলি আহমেদ হুসেনের শানাইয়ে ললিত রাগের মূর্ছনায়, তা যেন হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেল। নতুন শতকের শুরুর দিকে চাকদহ পুরসভার উদ্যোগে সংস্কৃতি চর্চার নতুন কেন্দ্র সম্প্রীতি মঞ্চ স্থাপিত হলেও ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠানের সেই ট্র্যাডিশন ফিরে এল কই। “
দীর্ঘদিন পরে আবার সেই অভিজ্ঞতা ফিরে পেতে চলেছেন চাকদহ বাসীরা। তবে নব পর্যায়ের এই আয়োজনে আপাততঃ শুধুই নবীন প্রতিভার প্রকাশ ও নিবেদন হবে আপনাদের সামনে। তবে চাকদহের সঙ্গীত চর্চা ও আয়োজনের পরম্পরা যে কার্যত সাময়িক বিরতির পরে “মীড়” এর সৌজন্যে পুনরায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আগামীদিনে সুররসিকদের মনোরঞ্জন করবে তা নিশ্চিত জানবেন।
তাই আগামী ২০ জুলাই সন্ধ্যায় সপরিবারে ও সবান্ধবে চলে আসুন সম্প্রীতি মঞ্চে “মীড়” এর চমকের জন্য। যেখানে দেখবেন সনাতন শাস্ত্রীয় ভাবধারায় নবীন প্রজন্মের নৃত্য-গীত উৎসবের উদযাপন। প্রবেশ অবাধ।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে দ্বীপ্তনীল ভট্টাচার্য (সরোদ), পলাশ কুড়ি (কণ্ঠ), দেবজ্যোতি বোস (তবলা), সগ্নিক দে (কন্ঠ্), শ্রীকণ্ঠ হালদার (কণ্ঠ), সোহিনী বন্দ্যোপাধ্যায় (কত্থক নৃত্য), স্বীকৃতি সাহা (কত্থক নৃত্য), গ্রেসি চৌধুরী (কত্থক নৃত্য) এর মতো তরুণ প্রজন্মের কিছু শিল্পী।