ডাক সাঁকারী : জমির “সাধ” ভক্ষণের কৃষি পার্বণ

– পার্থ চট্টোপাধ্যায়

বাংলার চাষিদের কাছে জমি হলেন “মা”। “মেয়ে”। মেয়ের কন্যা ধান। ধানে যখন দুধ আসে তখন তারও “সাধ ভক্ষণ” দেওয়া হয় আজকের দিনটিতে। এই উৎসবকে বলে “ডাক সাকরাণ”। দুটি বা একগুচ্ছ ধানের গাছের কাছে কলার ফাতনা দিয়ে পাঁকাটির তিনটি কাঠিকে যুক্ত করে কচু পাতার ওপর দেওয়া হয় ফল মূল বাতাসা,তালের আঁটি।ধানের গাছের গুচ্ছর মাথাকে সেই  ফল মূলের ওপর নুইয়ে দেওয়া হয়। কোথাও আশ্বিনের সংক্রান্তিতে, কোথাও কার্তিকে প্রথম দিনে ভোর বেলায় ছেলে মেয়েরা কুলো বাজিয়ে গৃহস্বামীর সাথে সাথে ধানের জমিতে চলে এই রকম মন্ত্র বলতে বলতে-

আশ্বিন যায় কার্তিক আসে,

মা লক্ষ্মী গর্ভে বসে,

সাধ খাও বর দাও হে-

আমাদের বাড়ির পোকা-মাকড়

ওদের বাড়ি যা

হরিণ শেয়াল খেয়ে গেল দূর্জয় দূর্জয়।”

এরপরে গৃহের কর্তা জমিতে পৌঁছে জমির চারদিকে পাটকাঠি পুঁতে দেয়।

বাংলায় নারীকে আমরা আশীর্বাদ করে বলি ,”ধরিত্রীর মতো হও “। ধরিত্রীর মতন সহনশীলতার কথা এখানে যেমন উচ্চারিত হয়,তেমনি ধরিত্রীর ভেতরে লুকিয়ে থাকে যে উর্বরা শক্তি তাকে লাভ করার কথাও বলা হয়।

লোকজীবনে নারীকে ভাবা হয় ধরির্তী। আবার ধরিত্রীকে ভাবা হয় নারী। এই কল্পনা থেকেই লোকসমাজ পালন করে ডাক- সাঁকরান বা সংক্রান্তী।

ডাক মানে হল আহ্বান। ডাক সংক্রান্তির ভেতর দিয়ে ফসল সম্ভবা জমিকে আহ্বান করা হয় সাধ ভক্ষণের। সাধ মানে ইচ্ছা। নয় মাসে সন্তান সম্ভবা মেয়েদের ইচ্ছা অনুসারে খাওয়ানোর অনুষ্ঠানকে বলা হয় “সাধভক্ষণ”। জমির সাধ ভক্ষণের এই উৎসব বাংলার নানা প্রান্ত সহ হুগলি জেলায় আবশ্যিক একটি কৃষি উৎসব।

বলাগড়ের কবুড়া পাঁচপাড়া ,প্রতাপপুর অঞ্চল জুড়ে আজকের দিনে পালিত এই উৎসব দেখতে গিয়ে অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাশ করা কৃতি ছাত্র সুমন মালিক জানালেন- “এই দিনটিতে আমরা জমিকে ফলবতী ভেবে, সন্তান সম্ভবা নারীর সাথে তুলনা করে শুদ্ধ বস্ত্রে তাকে সাধ দিই।বংশপরম্পরায় আমাদের এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে।”

আমরা জানি গ্রিক মাইথোলজিতে আকাশকে এমন পুরুষ দেবতা ভেবে তার বৃষ্টিকে ভাবি বীর্য। জমি হলেন মেয়ে। সেই বীর্য জমিতে এলে তবে সে গর্ভবতী হয়।

আমাদের ওয়াটসান্ডিস উপজাতিরা জমিতে একটি যোনীর মতন গর্ত খুঁড়ে একটি লাঠিকে ছুঁচালো করে ফসল চাষের আগের দিন একটি উৎসব করে। রাতের বেলায় ওই গর্তটি ঘিরে গান গাইতে গাইতে তারা লাঠিটিকে দিয়ে  গর্তে আঘাত করে। জমি আর লাঠিটির মিলন হল ।পরদিন জুম চাষ করা শুরু করে পাহারী ওয়াটসান্ডিস জনজাতি। এই লোক উৎসবকে বিষ্ণু দে তাঁর “ঘোরসওয়ার” কবিতাতেও ব্যবহার করেছেন।

গ্লোবালাইজেশনের চাপে আমাদের শেকরের গোড়ায় লুকোনো এই সমস্ত উৎসবেরা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমে। লোক সংস্কৃতির এই ছোট ছোট উৎসবগুলির ভেতরেই আসলে লুকিয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্যের শেকড়। এগুলি ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমে চলেছি শেকড়হীন জীবনের দিকে।


লেখক পরিচিতি: পার্থ চট্টোপাধ্যায়। নিবাস হুগলী জেলার জিরাটে। পেশায় বলাগড় বিজয়কৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ের সাহিত্যের শিক্ষক। পাশাপাশি জিরাট কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সভাপতি। সমাজসেবী স্বভাব ইতিহাস প্রেমী মানুষটি হুগলী জেলাকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মত। হুগলী সহ বাংলার কৃষ্টি, সৃষ্টি, সমাজ সাহিত্যকে রক্ষা করতে ও তুলে ধরতে এমন বদ্ধ পরিকর আন্তরিক চরিত্র ও ছাত্র দরদী শিক্ষক একালে কার্যতঃ বিরল। তাঁর লেখা কয়েক ডজন বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – হুগলি জেলার নৌশিল্প, শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত কথা, ঈশ্বর গুপ্ত : জীবন ও সাহিত্য, মোহিতলাল অন্বেষা, দ্রোণাচার্য ঘোষের ডাইরি ও কবিতা, রবিশস্য (১-৯ খন্ড), রবীন্দ্রনাথ ও হুগলি জেলা, হুগলি জেলার কবি ও কবিতা, গুপ্তিপাড়ার লোকগান হোলবোল, স্বাধীনতা সংগ্রামে হুগলি জেলা (সম্পাদিত), স্মরণীয় যাঁরা বরণীয় যাঁরা, স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্বে নজরুলের হুগলি জেলা, বঙ্গীয় রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস (সম্পাদিত), ইতিহাসের দর্পণে সাহিত্য সেতু, হুগলি জেলার তিন মহিলা কবি, গুপ্তিপাড়ার বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, ১ নভেম্বর ভারতে প্রথম বাংলা ভাষা বিজয় দিবস ইত্যাদি। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পঞ্চানন কর্মকার স্মৃতি পুরস্কার, রঙ্গলাল স্মৃতি পুরস্কার, সামাজিকতা পুরস্কারকালীপদ নন্দী স্মৃতি পুরস্কার, চারুপত্র সম্মান সহ আরো অন্যান্য সাহিত্য সম্মান ।

Share the news